নদী দখল ও প্যারাবন উজাড়

পাঁচ সচিবসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিশ বেলার

প্যারাবন উজাড় করে সেখানে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে স্থাপনা। বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট এলাকায়
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার শহরের পার্শ্ববর্তী বাঁকখালী নদী রক্ষায় হাইকোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও প্যারাবন কেটে নদী দখল, কক্সবাজার পৌরসভার সব আবর্জনা নদীতে ফেলে দূষণ অব্যাহত রাখা এবং আগের দখলদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাঁচজন সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকসহ ১৫ সরকারি কর্মকর্তা ও এক জনপ্রতিনিধিকে আদালত অবমাননার আইনি নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।

গতকাল সোমবার বেলার পক্ষে রেজিস্ট্রি ডাকযোগে নোটিশটি পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস হাসানুল বান্না। এতে ১৬ জুন সকাল ১০টার মধ্যে এ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ বেলার আইনজীবীকে অবহিত করার অনুরোধ জানানো হয়। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালতের আদেশ অবমাননার অভিযোগে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

যাঁদের নোটিশ পাঠানো হয়েছে—ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদ; পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী; জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী; চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন; পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল হামিদ; বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন; কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ; কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন রায়; পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক মুফিদুল আলম ও কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা; কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান, কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জিল্লুর রহমান।

কক্সবাজারের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র বদর মোকাম-কস্তুরাঘাট এলাকায় বাঁকখালী নদী ও এর তীরের সবুজ প্যারাবনের কয়েক শ একর গাছপালা উজাড় করে চলছে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক। সম্প্রতি প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্যারাবন ধ্বংস ও জলাভূমি ভরাট করে শতাধিক স্থাপনা নির্মাণের প্রতিবেদন প্রকাশিত করা হয়। এ ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তর অর্ধশতাধিক দখলদারের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করে। অবশ্য এ মামলায় একজন ছাড়া কেউ ধরা পড়েনি।

নোটিশ পাঠানোর সত্যতা নিশ্চিত করেন বেলার আইনজীবী এস হাসানুল বান্না। নোটিশে দ্রুত সময়ের মধ্যে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী বাঁকখালী নদীতে আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে, আদালতের সব আদেশ মেনে নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে এবং প্যারাবন উজাড় করে নির্মিত ও নির্মিতব্য সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

একই সঙ্গে বদর মোকাম–কস্তুরাঘাট এলাকায় নদীতে বিদ্যমান প্যারাবন সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়। ইতিমধ্যে ওই প্যারাবনের যে ক্ষতি হয়েছে, তা নিরূপণ করে প্রকৃত দোষীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় ও প্যারাবনকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে উপযোগী গাছের দ্বারা বনায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

নোটিশে বলা হয়েছে, অবৈধ দখল ও দূষণ থেকে রক্ষা করে বাঁকখালী নদীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বেলা ২০১৪ সালে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা করে। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং প্রাথমিক শুনানি শেষে ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বাঁকখালী নদীর দখলদারদের একটি তালিকা প্রস্তুত করার জন্য নির্দেশ দেন।

এ ছাড়া চিংড়ি বা তামাক চাষের উদ্দেশ্যে উল্লিখিত নদীর যেকোনো অংশ বা নদীতীর কাউকে ইজারা দেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি বাঁকখালী নদীকে কেন প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হবে না এবং সিএস ম্যাপ অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণ করে অবৈধ দখলদার ও দূষণকারীর হাত থেকে কেন নদীকে সংরক্ষণ করা হবে না—তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছিল।

পরে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি মামলার শুনানিকালে আদালত কক্সবাজার পৌরসভার মেয়রকে বাঁকখালী নদীতে বর্জ্য না ফেলতে নির্দেশ প্রদান করেন। একই সঙ্গে বর্জ্য ফেলার জন্য উপযুক্ত স্থান খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়—যা কোনো অবস্থাতেই পৌর এলাকা বা অন্য কোনো এলাকা, নদী বা খালের পরিবেশের ক্ষতি করবে না। এ ছাড়া অবিলম্বে বাঁকখালী নদীতে ফেলা বর্জ্য অপসারণ শুরু করার এবং নিজ খরচে নদী পরিষ্কার করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

বেলার নোটিশে বলা হয়, আদালতের এ রকম সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও বাঁকখালী নদীতে এখনো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বর্জ্য ফেলা অব্যাহত রয়েছে। নদীতীরে নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণ চলছে। সম্প্রতি কস্তুরাঘাট এলাকায় প্যারাবন কেটে নির্মাণ করা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। একই সঙ্গে নদী হিসেবে চিহ্নিত জায়গা বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রেকর্ড করা হয়েছে, যা দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম অবজ্ঞা ও উদাসীনতার পরিচায়ক।