কষ্টের ঈদযাত্রা

পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে দুর্গম চরে সন্তান জন্ম দিলেন সুরমা

জাজিরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নবজাতকের জন্য উপহারসামগ্রী প্রদান করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

পরিবার নিয়ে ঢাকার লালবাগে থাকেন মো. নাহিদ মিয়া ও সুরমা আক্তার দম্পতি। অন্তঃসত্ত্বা সুরমা ঈদের আগে রওনা হয়েছিলেন মায়ের বাড়ি বরগুনার আমতলীর পথে। দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ, পদ্মা পাড়ি দেওয়ার নৌযানও চলে না। কোনো রকমে একটি ট্রলারে করে এসে নামেন জাজিরার পদ্মা নদীর চরে। সেখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার পর প্রসববেদনা ওঠে। তখন চরের একটি বাড়িতে নেওয়া হয় সুরমাকে। বিকেল পাঁচটার দিকে কন্যাসন্তান জন্ম দেন ওই নারী। তখন আনন্দে মেতে ওঠেন ওই নারীর স্বজন ও মাঝিকান্দি গ্রামের মানুষ।

সন্তান প্রসবের পর ওই নারীর শারীরিক অবস্থা কিছুটা নাজুক হয়। তখন চর থেকে রাজ্জাক মাঝি নামের এক ব্যক্তি ফোন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশ্রাফুজ্জামান ভূঁইয়া ও উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসানকে। তাঁরা স্বাস্থ্যকর্মীদের পাঠিয়ে নৌ অ্যাম্বুলেন্সে করে ওই প্রসূতি ও নবজাতককে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে তাঁদের সেখানে ভর্তি করা হয়। সেখানে তাঁরা দুজনই সুস্থ আছেন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের উপহারসামগ্রী প্রদান করা হয়। আর এ আনন্দে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপস্থিত সবার মধ্যে মিষ্টিও বিতরণ করা হয়। শিশুটির নাম রাখা হয় ‘পদ্মা’।

চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন আগামী মাসে (জুন) তাঁদের সন্তান জন্ম নেবে। এ কারণে স্ত্রীকে তাঁর বাবার বাড়ি রাখার উদ্দেশে বরগুনা রওনা হয়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে পারেননি পদ্মা নদীতে কোনো নৌযান চলে না।
মো. নাহিদ মিয়া

নাহিদ মিয়ার বাড়ি বরিশালের হিজলা উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে। আর সুরমার বাবার বাড়ি বরগুনার আমতলীতে। দেড় বছর আগে তাঁদের বিয়ে হয়। ঢাকার লালবাগ এলাকার একটি স্টিলের ফার্নিচারের কারখানার শ্রমিক নাহিদ। এটা তাঁদের প্রথম সন্তান। জুনের শেষে সুরমার সন্তান জন্ম দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রখর রোদে পদ্মার চর দিয়ে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার সময় প্রসববেদনা ওঠে। তখন মাঝিকান্দি চরের বাসিন্দারা তাঁদের পাশে দাঁড়ান। ওই গ্রামের নারীদের সহায়তায় সুস্থভাবেই সুরমা সন্তান প্রসব করেন।

হাসপাতালে নেওয়ার পর ওই দম্পতির সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান। তিনি তাঁদের অভিনন্দন জানান, চিকিৎসা ও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেন। আর পদ্মা নদীর চরে সন্তান প্রসব হওয়ায় তার নাম রাখেন ‘পদ্মা’। সানন্দে তা মেনে নেন নাহিদ ও সুরমা দম্পতি।

জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এক নারী চরের মধ্যে সন্তান প্রসব করেছেন, এমন খবর পেয়ে নৌ অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। তাঁদের চিকিৎসা চলছে। এখন তাঁরা দুজনই সুস্থ আছেন।

মো. নাহিদ মিয়া বলেন, চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন আগামী মাসে (জুন) তাঁদের সন্তান জন্ম নেবে। এ কারণে স্ত্রীকে তাঁর বাবার বাড়ি রাখার উদ্দেশে বরগুনা রওনা হয়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে পারেননি পদ্মা নদীতে কোনো নৌযান চলে না। মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া এসে আটকা পরেন। নদীর তীর দিয়ে দুই কিলোমিটার হাঁটার পর দুপুরের দিকে একটি ট্রলারে চরে পদ্মা নদীর একটি চরে নামেন। সেখান থেকে হেঁটে রওনা হন। পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার পর তাঁর স্ত্রীর প্রসববেদনা ওঠে। তখন গ্রামবাসী তাঁদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। নাহিদ বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমি কন্যাসন্তান পেয়েছি। আমাদের বিপদে যেভাবে মানুষ পাশে দাঁড়িয়েছে, তাতে আমরা কৃতজ্ঞ।’

জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশ্রাফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, বাচ্চাটির প্রাথমিক চিকিৎসাসহ যাবতীয় খরচ বহন করা হবে। এমনকি বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও তাঁদের। এই পদ্মার চরে জন্ম নেওয়া শিশুটির ভবিষ্যতে পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব নেবেন এমন ঘোষণা দেন।