পর্যাপ্ত তথ্য ছাড়াই র‍্যাবের সংবাদ সম্মেলনে ক্ষোভ

ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানম
ছবি: সংগৃহীত

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনার কারণ এখনো স্পষ্ট হয়নি। দিনাজপুর জেলা প্রশাসনে ওয়াহিদার সহকর্মীরা বলছেন, পূর্ণাঙ্গ চিত্র না পেয়ে শুধু একজন সন্দেহভাজনের বক্তব্য ধরে সংবাদ সম্মেলন করা ঠিক হয়নি। সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়া যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর হোসেনকে ছেড়ে দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।

এদিকে একই হামলায় আহত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওয়াহিদা খানমের বাবা ওমর আলী শেখের (৭০) কোমরের নিচের অংশ হঠাৎ অবশ হয়ে গেছে। তবে ঢাকার আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ওয়াহিদার (৩৬) অবস্থা উন্নতির দিকে। তাঁর জ্ঞানের মাত্রা শতভাগ ঠিক আছে। হামলায় জ্ঞান হারানোর সময়কার কিছু কথাও তিনি মনে করতে পারছেন।

এদিকে ওয়াহিদা ও তাঁর বাবার ওপর হামলার প্রধান সন্দেহভাজন যুবলীগের স্থানীয় নেতা আসাদুল ইসলামকে সাত দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। জেলার পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন বলছেন, ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনাটি বিভিন্ন দিকে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

এদিকে গতকাল দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে কথা হয় জেলা প্রশাসনের তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁরা দৃঢ়ভাবেই মনে করেন, এটা ‘নিছক চুরির’ ঘটনা নয়। সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব যেভাবে কেবল একজন সন্দেহভাজনের বক্তব্য তুলে ধরেছে, তা সমীচীন হয়নি। অন্তত তদন্তের একটা পর্যায়ে গিয়ে বক্তব্য এলে সবার কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হতো।

এ ঘটনায় ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে আবার ছেড়ে দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। নাম না প্রকাশ করা শর্তে গতকাল দুজন কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে তাঁরা জেনেছেন, এ হামলার প্রধান সন্দেহভাজন যুবলীগ নেতা আসাদুল ইসলাম আর আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর হোসেনকে সবাই মানিকজোড় হিসেবেই চেনেন। সব অপকর্মে দুজনকে একসঙ্গেই দেখা যেত। জাহাঙ্গীর ২০১৭ সাল থেকে উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক। তিনিই আসাদুলকে কমিটির সদস্য বানিয়েছেন বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।

জাহাঙ্গীরকে র‍্যাব কেন ছেড়ে দিয়েছে, সেই ব্যাখা র‍্যাবই দিতে পারবে। তবে আমরা মনে করি, র‍্যাবের আরও অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন ছিল। বিষয়টিতে র‍্যাব আরও সময় নিতে পারত
মাহমুদুল আলম, জেলা প্রশাসক

এসব বিষয়ে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম বলেন, ‘জাহাঙ্গীরকে র‍্যাব কেন ছেড়ে দিয়েছে, সেই ব্যাখা র‍্যাবই দিতে পারবে। তবে আমরা মনে করি, র‍্যাবের আরও অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন ছিল। বিষয়টিতে র‍্যাব আরও সময় নিতে পারত।’ তিনি বলেন, ‘তদন্তের ক্ষেত্রে তাদের যখন যে ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, আমরা তা করে যাচ্ছি। তবে আমরা এখনো মনে করি, শুধু চুরির উদ্দেশ্যে এ ঘটনা ঘটেনি। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট উপজেলায় গত এক বছরে ইউএনওর সব কার্যক্রমের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।’

গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব-১৩–এর পরিচালক কমান্ডার রেজা আহমেদ ফেরদৌস সন্দেহভাজন আসাদুলের বরাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘নিছক চুরির অভিপ্রায়ে’ ঢুকে হামলার ঘটনাটি ঘটে যায়। যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীরের বিষয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে জাহাঙ্গীরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছিল। ঘটনার সঙ্গে সে রকম সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

র‍্যাব ছেড়ে দেওয়ার পর যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর বাড়িতে ফিরেছেন। গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের পর সম্পৃক্ততা না পেয়ে শুক্রবার রাতে তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে র‍্যাব। তাঁর দাবি, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। সম্প্রতি এলাকায় জনস্বার্থে কাজ করায় তাঁর সুনাম বৃদ্ধি হয়েছে। এসব কারণে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। কয়েক দিনের মধ্যে তিনি সংবাদ সম্মেলন বিস্তারিত জানানোর কথাও বলেন।

ওয়াহিদার অবস্থার উন্নতি

ওয়াহিদা খানমকে বিদেশে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমার মনে হয়েছে তিনি সুস্থ আছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাঁর খোঁজ নিচ্ছেন
জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্যমন্ত্রী

ওয়াহিদাকে দেখতে গিয়ে গতকাল বেলা ১১টার দিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘ওয়াহিদা খানমকে বিদেশে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমার মনে হয়েছে তিনি সুস্থ আছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাঁর খোঁজ নিচ্ছেন।’

ওয়াহিদা জ্ঞান হারানোর আগের কিছু কিছু ঘটনা মনে করতে পারছেন—এটা ভালো লক্ষণ। তাঁর জ্ঞানের মাত্রা শতভাগ ঠিক আছে। ওয়াহিদার হৃদ্‌যন্ত্র, রক্তচাপ ও স্নায়ুতন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছে। তাঁর অক্সিজেন স্যাচুরেশন স্বাভাবিক আছে। তাঁর শরীরের ডান পাশ এখনো অবশ। এ জন্য তাঁকে ফিজিওথেরাপি দেওয়া হচ্ছে। তাঁর মাথায় অনেক আঘাত ছিল। এ কারণে এখনো ব্যথা আছে। মাথার ব্যথাটা কিছুদিন থাকবে, পরে ধীরে ধীরে কমে যাবে
মো. জাহেদ হোসেন, ঢাকার নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের নিউরো ট্রমা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক

ঢাকার নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের নিউরো ট্রমা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. জাহেদ হোসেনের অধীনে চিকিৎসাধীন ওয়াহিদা। গতকাল সন্ধ্যায় অধ্যাপক জাহেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওয়াহিদা জ্ঞান হারানোর আগের কিছু কিছু ঘটনা মনে করতে পারছেন—এটা ভালো লক্ষণ। তাঁর জ্ঞানের মাত্রা শতভাগ ঠিক আছে। ওয়াহিদার হৃদ্‌যন্ত্র, রক্তচাপ ও স্নায়ুতন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছে। তাঁর অক্সিজেন স্যাচুরেশন স্বাভাবিক আছে। তাঁর শরীরের ডান পাশ এখনো অবশ। এ জন্য তাঁকে ফিজিওথেরাপি দেওয়া হচ্ছে। তাঁর মাথায় অনেক আঘাত ছিল। এ কারণে এখনো ব্যথা আছে। মাথার ব্যথাটা কিছুদিন থাকবে, পরে ধীরে ধীরে কমে যাবে।’

তবে ওয়াহিদাকে শঙ্কামুক্ত বলা যাবে কি না, তা রোববার মধ্যরাতের পর জানা যাবে। সোমবার সকালে এ বিষয়ে জানানো হবে বলে জানান অধ্যাপক জাহেদ।

এদিকে রংপুর মেডিকেলে চিকিৎসাধীন ওয়াহিদার বাবা ওমর আলী শেখের কোমরের নিচের অংশ হঠাৎ অবশ হয়ে গেছে। তবে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা ও খাওয়াদাওয়া ঠিকভাবে করছেন তিনি। রংপুর মেডিকেলের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান তোফায়েল হোসেন ভূঁইয়া বলেন, তাঁর এমনিতেই ডায়াবেটিস ছিল। ঘটনার রাতে তিনি ঘাড়ে আঘাত পান। স্পাইনাল কর্ডে আঘাতটি গুরুতর ছিল। এ ক্ষেত্রে তাঁর দুই হাত কিছুটা সচল থাকলেও কোমরের নিচ থেকে পা পর্যন্ত অবশ আছে। এটি সারতে কিছুটা সময় নেবে। এমনিতে তাঁর অবস্থা আগের থেকে দিন দিন উন্নতি হচ্ছে।

গত বুধবার মধ্যরাতে ঘোড়াঘাটের ইউএনওর সরকারি বাসভবনের ভেন্টিলেটর দিয়ে ঢুকে দুর্বৃত্তরা ওয়াহিদা ও তাঁর বাবার ওপর হামলা চালান।