পরেরবার আশা করি পারব: বাংলা চ্যানেলে ১০ বছরের লারিসা

বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিতে সমুদ্রে নামছে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ১০ বছর ৪ মাস বয়সী সৈয়দা লারিসা রোজেন। গতকাল কক্সবাজার জেলার টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড়ার সমুদ্রসৈকতে।
ছবি: গিয়াস উদ্দিন

বঙ্গোপসাগরের বাংলা চ্যানেলে এত কম বয়সী সাঁতারুকে আর দেখা যায়নি। তাই তো ঢাকার প্লে পেন স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ১০ বছর ৪ মাস বয়সী সৈয়দা লারিসা রোজেনকে নিয়ে আগ্রহ ছিল সবার। কিন্তু গতকাল সোমবার বঙ্গোপসাগরে প্রবল বাতাস ও ঢেউয়ের বৈরী আচরণে সাড়ে চার ঘণ্টা সাঁতরে অর্ধেক দূরত্ব (আট কিলোমিটারের বেশি) পেরিয়ে সাঁতার সমাপ্ত করেছে লারিসা। আয়োজকেরা বলছেন, ১০ বছরের একটা মেয়ে এমন উত্তাল সাগরে এতটা পথ পেরিয়েছে, এটাই বড় কথা।

ওদিকে লারিসা প্রথম আলোকে বলল, ‘আমার খুবই ভালো লেগেছে। আমি পাড়ি দিতে পারতাম, কিন্তু সাগরের এত খারাপ অবস্থা ছিল, মাঝেমাঝেই নিজেকে হেল্পলেস লাগছিল। পরেরবার আশা করি বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেব।’

এমনই আত্মবিশ্বাস লারিসার। মাত্র এক বছর ধরে সে সাঁতার অনুশীলন করে বাবা সৈয়দ আক্তারুজ্জামানের হাত ধরে। বাংলা চ্যানেল সাঁতারের বাছাইপর্বেও টানা চার ঘণ্টা সাঁতার কেটেছিল লারিসা। সে বলে, ‘বাবার খুব ইচ্ছা আমি বাংলা চ্যানেল সাঁতার দিই। বাবার স্বপ্ন পূরণে আমি এবার সাগরে নেমেছি। এখন আমার নিজেরও ইচ্ছা বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া।’

বাংলা চ্যানেলে সাঁতার শুরুর আগে জাতীয় পতাকা হাতে সাঁতারুরা। গতকাল সকালে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়া সমুদ্রসৈকতে।

৪৩ বছর বয়সী সৈয়দ আক্তারুজ্জামান মেয়ে লারিসা ও ছেলে ১৫ বছরের সৈয়দ আরবিন আয়ানকে নিয়ে সাঁতার শুরু করেন। সাগর উত্তাল থাকায় সাড়ে চার ঘণ্টায় অর্ধেক দূরত্ব পেরোনোর পর বেলা তিনটার দিকে তাঁদের পাশে থাকা উদ্ধারকারী নৌকার সদস্যদের পরামর্শে প্রথমে আরবিন, তার কিছুক্ষণ পর লারিসা ও আক্তারুজ্জামান নৌকায় উঠে আসেন। উদ্ধারকারীরা তিনজনেরই শক্তি ও সাঁতার–দক্ষতার প্রশংসা করেন।

আয়রনম্যান আরাফাত

উত্তাল সাগরে ওঁরা ৫৪ জন

রোববার রাত থেকে বঙ্গোপসাগরে ছিল প্রবল বাতাস ও ঢেউ। গতকালও সেই অবস্থা সকাল থেকেই। বাতাসের কারণে বড় বড় ঢেউ সাঁতারুদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ৭৯ জনের মধ্যে ৫৪ জন সাঁতারু এবার বাংলা চ্যানেলে সাঁতার সম্পন্ন করেন। আজ মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে সফল সাতারুদের নাম ঘোষণা করা হবে। এতসংখ্যক সাঁতারু এর আগে একসঙ্গে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেননি। গতবার ৩৯ জন সফল হয়েছিলেন।

সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহ্পরীর দ্বীপের পশ্চিম সৈকত থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে ১৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দূরত্বের বাংলা চ্যানেলে এই সাঁতার শুরু হয়। ৮০ জন নিবন্ধন করলেও শেষ পর্যন্ত ৭৯ জন দূরপাল্লার সাঁতারু অংশ নেন। সেন্ট মার্টিন থেকে সকালে শাহ্পরীর দ্বীপে পৌঁছান সাঁতারুরা। গা গরম শেষে, ৫০টি পতাকা নিয়ে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন করে তাঁরা সাগরে নামেন। বাংলা চ্যানেলে বার্ষিক এই সাঁতারের আয়োজক ষড়জ অ্যাডভেঞ্চার ও এক্সট্রিম বাংলা।

বাংলা চ্যানেলে নামছেন ৭৯ জন সাঁতারু

সবার আগে রাসেল

চলতি বছরই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বঙ্গোপসাগরের বাংলা চ্যানেল এপার–ওপার পাড়ি দিয়ে (ডাবল ক্রস) রেকর্ড করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর মো. সাইফুল ইসলাম রাসেল। গতকাল ৩ ঘণ্টা ৫০ মিনিট সময় নিয়ে সবার আগে ১৬তম ফরচুন বাংলা চ্যানেল সাঁতার সম্পন্ন করলেন ‘সি হর্স’ নামে পরিচিত এই সাঁতারু। তিনি পঞ্চমবারের মতো বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিলেন। এর পরপরই সাঁতার সম্পন্ন করেন ঝিনাইদহের সাঁতারু সুজা মোল্লা (৪ ঘণ্টা ১০ মিনিট)। তাঁর পর সাগর থেকে উঠে আসেন মো. আবু নাঈম (৪ ঘণ্টা ১৩ মিনিট)।

লিপটনের টানা ১৮ বার

২০০৬ সালে প্রথম বাংলা চ্যানেল সাঁতার সম্পন্ন করেন এই আয়োজনের প্রধান উদ্যোক্তা সাঁতারু লিপটন সরকার। এরপর কোনো বছর বাদ নেই। গতকাল ৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট সময় নিয়ে টানা ১৮ বার এই চ্যানেল পাড়ি দিয়ে রেকর্ড করলেন তিনি। লিপটন গত বছর ও চলতি বছর দুবার করে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেন।

সবার আগে সাগর পাড়ি দিলেন মো. সাইফুল ইসলাম

মুনিরের ১২, আয়রনম্যানের ৮ বার

‘আয়রম্যান’ মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাত ৪ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট সময় নিয়ে অষ্টমবারের মতো বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিলেন। বিটিভির চিত্রগ্রাহক মো. মুনিরুজ্জামান একই সময় নিয়ে এবার ১২ বারের মতো বাংলা চ্যানেলে সাঁতার সম্পন্ন করলেন। একই সময়ে সাঁতার শেষ করেন সালাহ উদ্দিন। তাঁদের আগে ৪ ঘণ্টা ১৭ মিনিট সময় নিয়ে সাঁতার শেষ করেছেন আরিফুর রহমান। ফরাসি নাগরিক সিগ ফ্রিড টানা দুবারের মতো এবার বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিলেন। মালয়েশিয়া আয়রনম্যান আয়োজনে আয়রনম্যান খেতাব পাওয়া ইমতিয়াজ ইলাহিও গতকাল সাঁতার শেষ করেছেন।

১২ বার বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া মো. মনিরুজ্জামান

ষড়জ অ্যাডভেঞ্চারের প্রধান নির্বাহী লিপটন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাগর ছিল উত্তাল। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে যা দেখেছি, তার চেয়েও খারাপ ছিল। ফলে নতুন সাঁতারুদের অনেকে সাঁতার সম্পন্ন করতে পারেননি। বাংলা চ্যানেলে প্রতিবছরই অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এটি খুবই আশা জাগায়। ২০১৩ থেকে বাংলা চ্যানেল সাঁতার আন্তর্জাতিক রীতি অনুসরণ করে আয়োজন করা হয়। এবারও সাঁতারুদের নিরাপত্তার সব ব্যবস্থাই ছিল।’

১৮বার বাংলা চ্যানেলজয়ী লিপটন সরকার

১৬তম বাংলা চ্যানেল সাঁতারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডের ব্র্যান্ড ফরচুন। রেসকিউ পার্টনার বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। অংশীদার হিসেবে আরও আছে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, ইউনাইটেড সিকিউরিটিজ, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড, ষড়জ, ভিসা থিং, স্টুডিও ঢাকা।

বঙ্গোপসাগরে দূরপাল্লার সাঁতার উপযোগী ১৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দূরত্বের বাংলা চ্যানেল আবিষ্কার করেন অ্যাডভেঞ্চার গুরু প্রয়াত কাজী হামিদুল হক। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো বাংলা চ্যানেল সাঁতার অনুষ্ঠিত হয়। এবার এ আয়োজন তাঁর স্মৃতির প্রতি নিবেদন করা হয়েছে।