শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার মেঘনা নদীর চরে মাচা তৈরি করে মাছ শিকার করেন বরিশালের উজিরপুরের মৌসুমি জেলেরা। গত বৃহস্পতিবার চরজানপুর এলাকায়।
শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার মেঘনা নদীর চরে মাচা তৈরি করে মাছ শিকার করেন বরিশালের উজিরপুরের মৌসুমি জেলেরা। গত বৃহস্পতিবার চরজানপুর এলাকায়।

পরিবারের সুখের জন্য দুর্গম চরে তাঁরা

পয়লা বৈশাখের পরপরই উজিরপুরের মৌসুমি জেলেরা শরীয়তপুরের গোসাইরহাটের মেঘনার চরে চলে আসেন। পাঁচ–ছয়জনের দল করে তাঁরা চরে থাকেন। মেঘনা নদীতে অন্তত ৪০টি দল মাছ শিকার করে। ওই মাছ বিক্রির টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দেন তাঁরা। বছরের ছয় মাস এলাকায় কোনো কাজ না থাকায় তাঁরা এখানে এসে মাছ ধরেন।

বরিশালের উজিরপুরের বাসিন্দা তাঁরা। কৃষিকাজ করে সংসার চালান। কিন্তু বছরের ছয় মাস এলাকায় কোনো কাজ থাকে না। এই সময়টায় বেকার বসে না থেকে তাঁরা চলে আসেন শরীয়তপুরের মেঘনা নদীর বিভিন্ন দুর্গম চরে। বছরের ছয় মাস চরের পানির ভেতর উঁচু মাচা করে থাকেন। চাই দিয়ে মাছ শিকার করে তা বিক্রি করে দেন। মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার চালান। এই টাকা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের পড়ালেখা, চিকিৎসাসহ নানা প্রয়োজন মেটে।

বরিশালের উজিরপুর উপজেলার কালবিলা গ্রামের বাসিন্দা উত্তম মজুমদার। তাঁর পরিবারে সাত সদস্য। তাঁর আয়েই সংসার চলে। দুই সন্তান পড়ালেখা করে। এলাকায় বোরোর মৌসুম শেষ হওয়ার পর বেকার হয়ে পড়েন তিনি। টানা ছয় মাস বসে থাকতে হয়। ওই সময়ে বাড়তি আয় করতে ছুটে আসেন শরীয়তপুরের গোসাইরহাটের মেঘনা নদীর চরে। উত্তম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বোরো ধান আবাদ করে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। এলাকায় অন্যান্য কাজ করলে দিনে তিন শ টাকার বেশি আয় করা যায় না। সাত সদস্যের সংসার, দুই সন্তানের পড়ালেখা, পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার খরচসহ নানা ধরনের ব্যয় আছে। কিন্তু সেই পরিমান আয় নেই। তাই পরিবারের সদস্যদের কষ্টের কথা ভেবে দুর্গম চরে এসেছি। ঝড়-বৃষ্টি আর দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছি।’

দুর্গম চরের মধ্যে নানা দুর্যোগ মোকাবিলা করে থাকতে হয়। এটা অনেক কষ্টের জীবন। পরিবারের সদস্যদের ভালো রাখতে এখানে মাছ শিকারের কাজ করছি।
শুকলাল মণ্ডল, বাসিন্দা, মশাং গ্রাম, উজিরপুর উপজেলা, বরিশাল

উজিরপুরের মশাং গ্রামের বাসিন্দা শুকলাল মণ্ডল এলাকায় কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন। বোরোর মৌসুম ছাড়া ওই এলাকায় তেমন কৃষিশ্রমিকের চাহিদা নেই। বছরের অধিকাংশ সময়ই বেকার থাকতে হয় অথবা অর্ধেক পারিশ্রমিকে কাজ করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয় তাঁকে। শুকলাল মণ্ডল বলেন, ‘দুর্গম চরের মধ্যে নানা দুর্যোগ মোকাবিলা করে থাকতে হয়। এটা অনেক কষ্টের জীবন। পরিবারের সদস্যদের ভাল রাখতে এখানে মাছ শিকারের কাজ করছি।’

উজিরপুরে জমিরবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা সুনিল চন্দ্র ঘরামি কৃষিশ্রমিক। এলাকায় কাজ না থাকায় বছরের ছয় মাস মেঘনা নদীর দুর্গম চরে মাছ শিকার করেন। সুনিল চন্দ্র ঘরামি জানালেন, ‘দুই বছর যাবৎ মেঘনা চরে মাছ শিকার করতে আসছি। এলাকায় কাজ নেই, তাই এখানে এসেছি। আয় অনেক ভালো। আমার দলে পাঁচজন আছেন। প্রতিদিন ছয়–আট হাজার টাকার মাছ পাই। একেকজনের দেড় হাজার টাকা আয় হচ্ছে। ওই আয় দিয়ে পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাই।’

শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর, আলওয়ালপুর ও কুচাইপট্টি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীর ২০ কিলোমিটার অংশে অসংখ্য চর রয়েছে। ওই চরগুলো বছরের পাঁচ থেকে ছয় মাস পানিতে তলিয়ে থাকে। পয়লা বৈশাখের পরপরই উজিরপুরের ওই মৌসুমি জেলেরা গোসাইরহাটের মেঘনার চরে চলে আসেন।

শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর, আলওয়ালপুর ও কুচাইপট্টি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীর ২০ কিলোমিটার অংশে অসংখ্য চর রয়েছে। ওই চরগুলো বছরের পাঁচ থেকে ছয় মাস পানিতে তলিয়ে থাকে। পয়লা বৈশাখের পরপরই উজিরপুরের ওই মৌসুমি জেলেরা গোসাইরহাটের মেঘনার চরে চলে আসেন। ৫-৬ জনের দল করে তাঁরা চরে থাকেন। মেঘনা নদীর ২০ কিলোমিটার অংশে এমন অন্তত ৪০টি দল রয়েছে। উঁচু মাচা নির্মাণ করে রাতে সেই মাচায় থাকেন আর দিনে মাছ শিকার করেন। চাই ও ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরেন তাঁরা। নদী থেকে চিংড়ি, টেংরা, বেলেসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকার করা হয়। ওই মাছ তাঁরা গোসাইরহাটের বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করেন।

শরীয়তপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, শরীয়তপুর জেলার ওপর দিয়ে পদ্মা ও মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়েছে। ৫০ কিলোমিটার পদ্মা আর ২০ কিলোমিটার মেঘনা নদীতে জেলার ২৭ হাজার ২৪৫ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। যাঁরা সারা বছরই মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এর বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে বর্ষা মৌসুমে জেলেরা নদীতে মাছ শিকার করতে আসেন।