পরিবারটিতে আনন্দের কমতি ছিল না, একটি দুর্ঘটনায় সব শেষ

হাসিখুশি পরিবারটির তিনজন এখন কেবলই ছবি। সড়ক দুর্ঘটনায় মাসুদুর রহমানের স্ত্রী ইফরাত সুলতানা, ছেলে মাশবুবুর রহমান ও মেয়ে সোয়াইবা রহমান নিহত হয়েছেন
সংগৃহীত

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইফরাত সুলতানা (৪০)। চাকরির সুবাদে দুই সন্তান মাশবুবুর রহমান (১২) ও সোয়াইবা রহমানকে (৬) নিয়ে সিরাজগঞ্জে বাবার বাড়িতে থাকতেন। স্বামী থাকতেন ঢাকায়। বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে চশমা ভেঙেছিল মাশবুবুর। ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ইফরাত তাই চশমা কিনতে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের আর বাড়ি ফেরা হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় পথেই নিভে গেছে তাজা তিনটি প্রাণ।

একসঙ্গে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হারিয়ে বিলাপ যেন থামছে না মাসুদুর রহমানের (৫০)। সিরাজগঞ্জ পৌর শহরের মিরপুর দক্ষিণ মহল্লার আনন্দে ভরপুর বাড়িটিতে এখন শুধুই বিষাদের ছায়া।

গতকাল রোববার দুপুর ১২টার দিকে সিরাজগঞ্জ শহরের কালাচান মোড় এলাকায় দুর্ঘটনাটি ঘটে। এনায়েতপুর থেকে সিরাজগঞ্জমুখী একটি যাত্রীবাহী বাস একটি ট্রাককে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে একটি রিকশাকে চাপা দেয়। এতে রিকশাটি দুমড়েমুচড়ে যায়। এ ঘটনায় মা ও ছেলে ঘটনাস্থলেই মারা যান। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মেয়ে সোয়াইবা রহমানকে মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত রিকশাচালক চান মিয়াকে সিরাজগঞ্জ ২৫০ শয্যা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

আজ সোমবার সকালে নিহত ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় ইফরাত সুলতানার বড় ভাই মুশফেকুস সালেহীনের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁরা তিন ভাই–বোন। তিনি সবার বড়। ইফরাত সুলতানা আর ইসরাত সুলতানা দুজন ছিল যমজ বোন। ইসরাত লন্ডনে থাকেন। তিন ভাই–বোনের মধ্যে শুধু ইফরাতের দুই সন্তান ছিল।

তিনি বলেন, ‘আমার বোনের সংসারে আনন্দের কোনো কমতি ছিল না। ছেলেটা থাকত চুপচাপ আর মেয়েটা ছিল তার উল্টো। তার স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় সেই স্বপ্নটাও নিভে গেল। কে জানত ওটাই ছিল ওদের বাড়ি থেকে শেষ বের হওয়া। ওটা তো দুর্ঘটনা নয়, আমাদের স্বপ্নকে চুরমার করে দেওয়ার যন্ত্রণা।’

বাড়িতে বসে মাসুদুর রহমান বলছিলেন, ‘দুর্ঘটনায় আমার স্বপ্ন প্রদ্বীপ নিভে গেল। আমার সহধর্ধিণী ও সন্তানেরা আমায় রেখে চলে গেল। ওরা আমার সঙ্গে কথা না বলে এক দিনও ভাত খায়নি...।’ কথা বলতে বলতেই স্ত্রী-সন্তানের ছবি হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

সিরাজগঞ্জে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মাশবুবুর ও সোয়াইবা

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ইফরাতের স্বামী মাসুদুর রহমান (৫০) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করে সিরামিক শিল্পের কাজে জড়িয়ে পড়েন। মাসুদুর রহমান ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলায় কালেঙ্গা গ্রামের বজলুর রহমানের ছেলে। সিরামিক শিল্পী হিসেবে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। ঢাকার সাভারে তাঁর সিরামিক নকশার একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বনবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন স্ত্রী ইফরাত সুলতানা। ২০০৭ সালের ইফরাত সুলতানার সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন মাসুদুর। চাকরির সুবাদে ইফরাত তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে সিরাজগঞ্জ পৌর শহরের মিরপুর দক্ষিণ মহল্লায় বাবার বাসায় থাকতেন। সেখানেই শহরের স্কুলে পড়ালেখা করতো তাদের দুই সন্তান। মাশবুবুর রহমান পৌর শহরের সবুজ কানন স্কুল অ্যন্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সোয়াইবা পড়ত শহীদ মডেল স্কুলের নার্সারিতে।

বাড়িতে ঘোরাঘুরি করছিল নিহত শিশু দুটির খেলার সাথি জিম, নাহিয়ান ও অফি। তাঁরা জানাল, দুজনই তাদের সঙ্গে নিয়মিত খেলাধুলা করত। স্কুল বন্ধ থাকায় সেদিন সকালে ওদের বাড়ির উঠানে সবাই খেলছিল। হঠাৎ করে মাশবুবুরের চশমা ভেঙে যায়। পরে ওর মা ওদের সঙ্গে নিয়ে চশমা কিনতে যাওয়ার পথেই এমনটি ঘটল।

ইফরাতের সহকর্মী বনবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহনাজ পারভীন সহমর্মিতা জানাতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, ইফরাত সুলতানা একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। তিনি পরম আদরে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করাতেন। তাঁর এই অকালমৃত্যুতে ছাত্রছাত্রীরা শুধু একজন ভালো শিক্ষককেই হারায়নি, একই সঙ্গে একজন আদর্শ মা হারাল।

সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাহা উদ্দিন ফারুকী বলেন, নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার মামলা না করায় সবশেষে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করা হয়েছে। বাসটি আটক করে থানায় রাখা হয়েছে।