৬৫ বছর বয়সের রানু বেগমের বাড়ি ছিল শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর গ্রামে। ২০ বছর আগে স্বামী মারা যান। ছেলে মোতালেব দেওয়ানকে আঁকড়ে ধরে জীবন কাটাচ্ছিলেন। কোনো অভাব ছিল না চার সদস্যের পরিবারে। গত বছরের আগস্টে পদ্মার ভাঙনে সবকিছু পাল্টে যায় তাঁর। বসতবাড়ি, ফসলি জমি, ছেলের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খাবার হোটেল নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব রানু বেগমের ঠাঁই মিলেছে নড়িয়া পৌরসভার পূর্ব নড়িয়া গ্রামের একটি ভিটায়। ছেলে মোতালেব দেওয়ান ব্যবসা ছেড়ে স্থানীয় বাজারে একটি খাবার হোটেলে শ্রমিকের কাজ নিয়েছেন। ওই আয়েই কোনোরকমে সংসার চলছে। চোখের পানি মুছতে মুছতে রানু বেগম বলেন, ৪৫ বছর আগে দেওয়ান বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন। এরপর আর অভাব চোখে দেখেননি। জীবনের শেষ বেলায় এসে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেলেন। তাঁর সোনার সংসার পদ্মায় গ্রাস করেছে।
রানু বেগমের মতো নদীভাঙনে সব হারিয়ে নিঃস্ব কয়েক হাজার পরিবার নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করছে। অনেকে জমি ভাড়া নিয়ে বসতি গড়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, গত বছর জুলাই মাস থেকে নড়িয়ার তিনটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার দুটি ওয়ার্ডে ভাঙনে অন্তত ছয় হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছে।
বিলীন হয়েছে স্থানীয় বাজারের সাড়ে তিন শ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তিনতলা দুটি ভবনও বিলীন হয়ে যায়।
স্থানীয় প্রশাসন জানায়, জেলা প্রশাসন ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ৫ হাজার ৮১ পরিবারকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত খাদ্য সহায়তা হিসেবে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল দিয়েছে। দুই বান্ডিল করে টিন ও ছয় হাজার করে টাকা দিয়েছে ২ হাজার ৮২৫ পরিবারকে।
নড়িয়ার চরজুজিরা গ্রামের বাসিন্দা আবু বকরের চা-পানের দোকান ছিল ওয়াপদা বাজারে। গত বছর পদ্মার ভাঙনে ২৪ শতাংশ জায়গার ওপর থাকা বসত বাড়ি ও ওয়াপদা বাজারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি বিলীন হয়ে যায়। পরিবারের চার সদস্য নিয়ে বিপাকে পড়েন আবু বকর। এখন নড়িয়া পৌরসভার পূর্ব নড়িয়া এলাকায় দুই শতাংশ জমি ভাড়া নিয়ে বসতি গড়েছেন।
আবু বকর বলেন, ‘চা-পানের দোকান ছিল। আর স্ত্রী গবাদিপশু পালন করত। এ আয় দিয়ে সংসার ভালো চলত। পদ্মা নদী আমাদের সুখ গ্রাস করেছে। পাঁচ মাস বেকার থাকার পর গত জানুয়ারি থেকে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসে শ্রমিকের কাজ নিয়েছি। যা আয় হয়, তা দিয়েই কোনোরকমে বেঁচে আছি।’
পূর্ব নড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা কাদির ফকির (৭০)। গত বর্ষায় পদ্মার ভাঙনে ১১ শতাংশ জমিসহ বসতবাড়ি বিলীন হয়ে যায়। ছেলে হাইবক্স ফকির অটোরিকশা চালিয়ে ও বসতবাড়িতে গবাদিপশু পালন করে সংসার চালাতেন। হাইবক্স এখন আর আগের মতো আয় করতে পারেন না। সংসারে অভাব লেগেই আছে।
কাদির ফকির বলেন, তিনি অসুস্থ। তারপর সংসারের অন্য খরচ তো আছেই। ছেলে যা আয় করেন, তা দিয়ে চলা যায় না। তাই অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়। অসুস্থ হলে অনেক সময় ওষুধ কেনার টাকা থাকে না।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, গত বর্ষায় পদ্মার ভাঙনে এ এলাকার কয়েক হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবারগুলো দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। পরিবারগুলোকে সরকারিভাবে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আরও সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি ভেবে দেখা হবে।