রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার পদ্মাপাড়ের দেবগ্রামে এখন শেষটুকু বাঁচানোর চেষ্টায় ভিটেমাটি হারাতে বসা গ্রামবাসী। কেউ বসতঘর সরাচ্ছেন। কেউ ভিটায় লোকজন নিয়ে গাছ কাটছেন। মায়ের কবরের পাশে পানিতে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো প্রার্থনা করতে দেখা গেল তিন ভাই গোলজার শেখ (৭০), আমজাদ হোসেন (৬৫) ও মোছের শেখকে (৬০)। পদ্মার ভাঙনে এই তিন ভাই আগেই গ্রাম ছেড়েছেন। শূন্য ভিটার পাশে মা গোলজান বিবির কবরটি ছিল। সেটি বিলীন হওয়ার পথে খবর পেয়ে গতকাল এসেছিলেন।
পদ্মাপাড়ে এখন ভাঙনের করুণ সুর। কেবল গোয়ালন্দ নয়, শরীয়তপুরের জাজিরা ও নড়িয়া এবং মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় বেশ কিছু গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেই বেশ কিছু আবাদি জমি, বসতভিটা, বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়েছে।
ধস দেখা দিয়েছে শরীয়তপুরের নড়িয়া ও জাজিরায় হাজার কোটি টাকার বাঁধেও। ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘নড়িয়া-জাজিরা পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা প্রকল্প’টি বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। শরীয়তপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকাশ কৃষ্ণ সরকার বলেন, প্রকল্পের ৯ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ কিলোমিটারে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। নড়িয়ার কেদারপুরের ধসে যাওয়া বাঁধের ওই অংশ লাগোয়া কয়েকটি পুকুর ছিল। গভীর পুকুর থাকার কারণে নিচ দিয়ে পানি ঢুকে বাঁধ ধসে গেছে। জরিপে দেখা গেছে, ওই জায়গায় এখন পানির গভীরতা ৩০ মিটার।
নির্বাহী প্রকৌশলীর দাবি, এখন বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। ভাঙন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। নদীতে স্রোত থাকা পর্যন্ত বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হবে।
১৯ সেপ্টেম্বর বাঁধের সাধুর বাজার এলাকায় ৪০ মিটার অংশে ধস দেখা দেয়। ধসের কারণে কেদারপুর গ্রামের ৫৮টি পরিবার ওই স্থান থেকে সরে গেছে। আর গত বৃহস্পতিবার রাতে ১২টি বসতঘর বিলীন হয়েছে। রোববার সকালে ভাঙনকবলিত উত্তর কেদারপুর গ্রামে যান পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ও উপমন্ত্রী এনামুল হক। উপমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আশা ছিল এ বছর নড়িয়ায় কোনো ভাঙন হবে না। বর্ষার শেষ সময়ে ছোট একটি জায়গা ধসে গেছে।’ তাঁর দাবি, তীব্র ভাঙনের হাত থেকে নড়িয়াকে বাঁচাতে পেরেছেন তাঁরা।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নে ১০ দিন ধরে নদীভাঙনের মাত্রা বেড়েছে। এর মধ্যেই ১০০ বসতভিটা এবং শতাধিক বিঘা কৃষিজমি বিলীন হয়েছে। ভাঙনঝুঁকিতে রয়েছে আরও চার শতাধিক পরিবার। শুক্রবার দেবগ্রাম ইউনিয়নের নদীভাঙন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ পরিবার আতঙ্কে অন্যত্র সরে গেছে। পড়ে থাকা শূন্য বসতভিটা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দেবগ্রামের রোকন শেখকে (৫৫) দেখা গেল লোকজন নিয়ে ভিটায় থাকা গাছ কাটছেন। তিনি বলেন, প্রায় ১০ বিঘা জমিসহ বাড়ি ছিল। স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ ভালোই ছিলেন। কিন্তু পদ্মার ভাঙনে গত বছর কিছু অংশ যাওয়ার পর এ বছর অবশিষ্ট যা ছিল, সবই নদীতে চলে যাচ্ছে। ভাঙন-আতঙ্কে কিছুদিন আগে বসতঘর সরিয়ে পাশের কাটাখালী ইউনিয়নে নিয়েছেন। এখন ভিটার গাছ কাটছেন।
রাজবাড়ী-১ আসনের সাংসদ কাজী কেরামত আলী বলেন, ভাঙন ঠেকাতে ইতিমধ্যে কিছু স্থানে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে পাউবো। ভাঙন প্রতিরোধে বড় ধরনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে।
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহে বন্দরখোলা, কাঁঠালবাড়ি ও চরজানাজাত ইউনিয়নে নদীভাঙনে বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কয়েক শ দোকান ও বসতঘর বিলীন হয়েছে। পাঁচ শতাধিক দোকান, ঘরবাড়ি সরিয়ে অন্যত্র আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে ভাঙনকবলিত লোকজন। চরজানাজাত ইউনিয়নের দুটি বিদ্যালয়সহ আরও দুটি বিদ্যালয় অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে চারটি বিদ্যালয়, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বহু স্থাপনা।
পাউবোর মাদারীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম সাহা বলেন, কাঁঠালবাড়ি ও চরজানাজাত ইউনিয়নের যে এলাকাগুলো নদীতে ভাঙছে, সেখানে প্রচণ্ড স্রোত। প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ সরকারি নানা স্থাপনা ঠেকাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ভাঙন ঠেকানো যায়নি। এখন পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের ভাঙনকবলিত এলাকার পাশেই পদ্মা সেতুর কাজ চলছে। তাই আগে থেকে ভাঙন ঠেকাতে গেলে সেতুর কাজ বাধাগ্রস্ত হতো। এখানে ভাঙন রোধ করতে হলে বড় ধরনের প্রকল্প হাতে নিতে হবে। এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।