‘পঞ্চাশের পাহাড়’ এলাকা থেকে উত্তোলন করা এসব পাথর স্তূপ করে রাখা হয়েছে গুঁড়ো করার জন্য। সম্প্রতি সিলেটের জৈন্তাপুরের বাংলাবাজার-কাটাগাঙ ও আসমপাড়া এলাকার পাথর ভাঙার কলে।
‘পঞ্চাশের পাহাড়’ এলাকা থেকে উত্তোলন করা এসব পাথর স্তূপ করে রাখা হয়েছে গুঁড়ো করার জন্য। সম্প্রতি সিলেটের জৈন্তাপুরের বাংলাবাজার-কাটাগাঙ ও আসমপাড়া এলাকার পাথর ভাঙার কলে।

‘পঞ্চাশের পাহাড়’ কেটে পাথর-বাণিজ্য

সিলেটের জৈন্তাপুরে একের পর এক টিলা কেটে পাথর তোলা হচ্ছে। সেই পাথর রাতের আঁধারে ট্রাকে করে নেওয়া হয় পাথর ভাঙার কলে। ব্যবসায়ীরা সেই পাথর গুঁড়া করে বিক্রি করেন টাইলস তৈরির কারখানায়।

প্রায় দেড় মাস ধরে জৈন্তাপুর উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়নে চলছে এই পাথর–বাণিজ্য। পাহাড়-টিলার পাদদেশের বাসিন্দারা পাথর তোলাকে বাড়তি রোজগার হিসেবে নিয়েছেন। ঠিক কতজন এ কাজে জড়িত, এর কোনো সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে পাথর ভাঙার কলের একটি হিসাব পাওয়া গেছে। উপজেলা প্রশাসনের হিসাবে, জৈন্তাপুরে ৬৮টি পাথর ভাঙার কল রয়েছে। সরেজমিন অবশ্য চার গুণ বেশি কলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব কলের অধিকাংশ এখন বন্ধ। যেগুলো সচল আছে, সেগুলোর মধ্যে ‘টমটম’ নামে ভ্রাম্যমাণ কলে ‘পঞ্চাশের পাহাড়’ এলাকা থেকে কেনা পাথর ভাঙা হয় বেশি।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়মালার সঙ্গে মিল আছে সিলেটের জৈন্তাপুরে ‘পঞ্চাশের পাহাড়’র। সম্প্রতি চারিকাটার বনপাড়া এলাকায়।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়মালার মতোই বাংলাদেশের জৈন্তাপুরের চারিকাটা এলাকায় পাহাড়-টিলা রয়েছে। জৈন্তাপুরের সারীঘাট থেকে চারিকাটা ইউনিয়ন পুরোটা মেঘালয়ের পাহাড়ের মতো একটি বেষ্টনী। পঞ্চাশের পাহাড় নামের ওই বেষ্টনীর আশপাশে রয়েছে আরও অর্ধশতাধিক টিলা। পঞ্চাশের পাহাড়ের ঢালে পড়েছে ছোট ছোট টিলা। এসব টিলা খুঁড়েই পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে।

১২ জুন চারকাটা ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার এক পাশে স্তূপ করে রাখা পাথর। মধ্যে একটি খুঁটি পোঁতা। এই খুঁটিই স্তূপ করে রাখা পাথর বিক্রির গোপন সংকেত। দিনে এভাবে রেখে বিক্রি হয় রাতে। পাথর স্তূপের পাশে সুউচ্চ একটি টিলা। নাম হরীতকীর টিলা। পাথর তোলা হয়েছে ওই টিলার ঢাল কেটে। এসব পাথর দেখতে মলিন বলে ডাকা হয় ‘মরা’ পাথর বলে। জৈন্তাপুর উপজেলা প্রশাসন টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অভিযান চালিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক আহমদ এ প্রবণতাকে ভয়ংকর বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের উত্তর–পূর্ব পাহাড়-টিলা বেসিনে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়গুলো সুবিশাল একটি প্রাকৃতিক ঢাল। সেখানেও পাহাড় ধ্বংস হচ্ছে। যে কারণে ভাটি অঞ্চলে পলি মাটির বদলে পাহাড়ি বালু আসছে। ভূমিরূপ খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ভারতের মতো না হলেও একই পাহাড়-টিলা বেসিন সিলেটের জৈন্তাপুরে আছে।

সেখানে যদি এভাবে পাহাড়ের গা কেটে ফেলা হয়, তাহলে সেটা এককথায় ভয়ংকর।’
সম্প্রতি সিলেটে একাধিক ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। এই সময়ে এ প্রবণতাকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই জানিয়ে অধ্যাপক মুশতাক আরও বলেন, এভাবেই পাহাড়-টিলা নড়বড় হয়। তখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়কর অবস্থা সামাল দেওয়া যাবে না। এ জন্য এখনই প্রতিকারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

সিলেটের জৈন্তাপুরে ‘পঞ্চাশের পাহাড়’ পাদদেশের টিলা কেটে এভাবেই পাথর উত্তোলন করা হয়। চারিকাটার ভিত্রিখেল-মনতৈল এলাকায়।

চারিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহ আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, এসব টিলা সরকারি খাস খতিয়ানের। আশপাশ এলাকার বাসিন্দারা টিলার অংশ দখল করে রেখে কাজটি করছেন।

সম্প্রতি সরেজমিন মনতৈল থেকে হেঁটে আরও চারটি গ্রামের সাতটি টিলা যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি অবস্থায় দেখা গেল। পঞ্চাশের পাহাড় সারির অধিকাংশ পড়েছে বনপাড়ায়। সেখানে একটি পাহাড়চূড়ায় উঠে দেখা গেছে, পাহাড়ি বন-ঝোপের আড়ালে রাতারাতি ঘর নির্মাণ করে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে ক্ষতবিক্ষত হওয়ায় ধস থেকেও পাথর তোলা হয়। সার্বিক অবস্থাকে ‘উমধুম’ বলে মন্তব্য করেন ওই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা মাসুক আহমদ। পেশায় তিনি কৃষিজীবী। উদ্বিগ্ন মাসুক বলেন, ‘এই উমধুম না থামাইল এইখানের পাহাড়-টিলা আর আস্তা থাকত না। যারা এই পাথর কিনে, তারারে আগে ধরা দরকার।’

পঞ্চাশের পাহাড় এলাকায় যেসব পাথর স্তূপ করে রাখা দেখা গেছে, সেসব পাথরই পাওয়া গেছে জৈন্তাপুর উপজেলার বাংলাবাজার, আসামপাড়া ও কাটাগাঙ এলাকায় কয়েকটি পাথর ভাঙার কলে। কাটাগাঙের পারভেজ স্টোন ক্রাশার মিল, রূপালী স্টোন ক্রাশার মিল, মাশাল্লাহ স্টোন ক্রাশার মিল, সেলিম চৌধুরী স্টোন ক্রাশার মিল, এমজে স্টোন ক্রাশার মিলের আঙিনায় এসব পাথর রেখে গুঁড়া করা হচ্ছে।

জৈন্তাপুর উপজেলা প্রশাসন গত ২৭ মে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে ৩০ ট্রাক পাথর জব্দ করে। ওই পাথর প্রকাশ্যে নিলামে বিক্রি হয় ৮০ হাজার টাকায়। নিলাম ডাকের ক্রেতা ছিল জৈন্তাপুরের রাসেল আহমদের নেতৃত্বে পাথর ব্যবসায়ীদের একটি দল। অভিযোগ রয়েছে, ওই নিলাম ডাকে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরাই পাহাড়-টিলা কেটে মরা পাথরের ক্রেতা। ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে গত প্রায় দেড় মাসে অন্তত দুই হাজার ট্রাক পাথর কেনাবেচা হয়েছে।

মিলমালিকেরা এসব পাথর গুঁড়া করে টাইলস কারখানায় টাইলস তৈরির কাঁচামাল হিসেবে বিক্রি করার বিষয়টি স্বীকার করেন। পাথর গুঁড়া ৬০ টাকা ফুট দরে কিনে বিক্রি করা হয় ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায়। পাহাড়-টিলা কেটে অবৈধভাবে উত্তোলন করা পাথর কেনাও একধরনের অপরাধ কি না, জানতে চাইলে কাটাগাঙের একটি কলের মালিক মামুন পারভেজ বলেন, ‘বৈধ-অবৈধ জানি না, আমরা তো টাকা দিয়েই কিনছি। বিক্রি বা উত্তোলন বন্ধ হলেই তো আমরা এসব আর পাব না।’

জানতে চাইলে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুসরাত আজমেরী হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ২৭ মে একটি অভিযান হওয়ায় এ প্রবণতা কিছুটা কমেছে। তবে আমরা জানতে পেরেছি চক্রটি কৌশল বদল করে এখন দিনে নয়, রাতে বেশি তৎপর। যেহেতু বিষয়টি পাহাড়-টিলা কর্তন, অবৈধ এই তৎপরতা বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’

টিলা কেটে তোলা পাথর বিক্রির জন্য এভাবেই স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি চারিকাটার ইটাখলা রাস্তায়।

পরিবেশ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করলে সিলেট বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসন থেকে আমাদের জানানো হয়েছে। আমরা সমন্বিত একটি অভিযান করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনের এ ভূমিকা কালক্ষেপণ বলে মনে করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক শাহ সাহেদা। তিনি বলেন, পরিবেশ আইন ছাড়াও সিলেট অঞ্চলে পাহাড়-টিলা কাটার বিরুদ্ধে উচ্চ আদলতের সরাসরি নির্দেশনা আছে। আদালতের এই নির্দেশনার আলোকেই প্রশাসন তাৎক্ষণিক একটি বা দুটি নয়, ধারাবাহিকভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে।