নৌকাডুবিতে দুই সন্তানসহ একসঙ্গে চার আপনজনকে হারিয়ে ডেজিয়ারা বেগম (২৬) দিশেহারা। তিনি অনেকটা উদ্ভ্রান্ত, প্রায়ই অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নের বোগলাউড়ি ঘাট থেকে দশরশিয়া ঘাট যাওয়ার পথে ওই ইঞ্জিনচালিত নৌকা ডুবে যায়। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত চারজনের লাশ উদ্ধার হলেও তিনজন নিখোঁজ। অভিযোগ রয়েছে, ওই দিন আবহাওয়া খারাপ থাকার পরও গাদাগাদি করে প্রায় অর্ধশত মানুষ তোলা হয়েছিল মালবোঝাই নৌকায়।
সেদিন নৌকায় ডেজিয়ারা বেগম, তাঁর তিন শিশুসন্তান, মা-বাবা ও এক ভাতিজাসহ পরিবারের মোট ৭ জন ছিলেন। নৌকাডুবির দিন তাঁর দুই বছরের শিশুকন্যা মাইশা ও মা নিলুফা বেগমের (৫০) লাশ পাওয়া যায়। এর দুই দিন পর তাঁর শিশুপুত্র আসমাউলের লাশ (৭) উদ্ধার হয়। এক সপ্তাহ পার হলেও ডেজিয়ারার বাবা খাইরুল ইসলাম (৫৫) এখনো নিখোঁজ। ধারণা করা হচ্ছে, বাবাও বেঁচে নেই। কোনোরকমে বেঁচে যান ডেজিয়ারা ও তাঁর বড় ছেলে সাজিদ (৮)।
ডেজিয়ারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের ছাব্বিশ রশিয়া গ্রামের মো. ফিটু ওরফে বাবুর (৩৩) স্ত্রী। তাঁর বাবার বাড়ি শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নের বিশরশিয়া গ্রামে।
নৌকাডুবির দিন তাঁর দুই বছরের শিশুকন্যা মাইশা ও মা নিলুফা বেগমের (৫০) লাশ পাওয়া যায়। এর দুই দিন পর তাঁর শিশুপুত্র আসমাউলের লাশ (৭) উদ্ধার হয়। এক সপ্তাহ পার হলেও ডেজিয়ারার বাবা খাইরুল ইসলাম (৫৫) এখনো নিখোঁজ।
আজ মঙ্গলবার সন্ধায় মুঠোফোনে কথা হয় ডেজিয়ারার সঙ্গে। তিনি কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘কইলজ্যাটা ছিঁড়্যা যাইছে। মা-বাপ আর দুটা নাড়ি ছিঁড়া ধন হারাইলে জীবনটাতে আর থাকে কী? বাঁইচ্যা যাওয়া হামার আর এক ছাইলা সাজিদকে মা হারা কইরবে না বলে আল্লাহ বুঝিন হামাকে বাঁচিয়্যা থুইয়্যাছে। চোখর পাতা এক করতে পারি না। চোখ বুজলেই পদ্মা লোদ্দীর সেদিনের দৃশ্য চোখের সামনে ভাইস্যা উঠছে।’
ডেজিয়ারার স্বামী মো. ফিটু ধরা গলায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্ত্রী দুই সন্তানের সঙ্গে বাবা-মাকে হারিয়ে এত শোক সইবে কেমন করে? আমিও তো দুই সন্তান ও শ্বশুর-শাশুড়িকে হারালাম। এখন কে কাকে সান্ত্বনা দেবে বলেন। সে দিশেহারা হয়ে পাগলের মতো আচরণ করছে। নাওয়া-খাওয়া নেই। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে। বলে, “আমার মাইশা আমার আসমাউল আর মা বলে ডাকে না ক্যান? মাইশা আমার বুকে আর ওঠে না ক্যান?”’ এসব বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন মো. ফিটু।
মো. ফিটু অভিযোগ করেন, সেদিন নদীতে ঢেউ ও বাতাস থাকার পরও মালবোঝাই নৌকাতে গাদাগাদি করে মানুষ বোঝাই করার জন্যই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। বোগলাউড়ি ঘাটে প্রায়ই এমন গাদাগাদি করে নৌকাতে মানুষ তোলা হয়। এগুলো দেখার কেউ নেই।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘ডেজিয়ারা বেগম আমার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে। তার শোকের সীমা–পরিসীমা নেই। মা-বাবা, সন্তানের চেয়ে আপন আর নাই। একসঙ্গে এত আপনজন হারানো মানুষকে কথা বলে সান্ত্বনা দিতে পারিনি। ভাষা খুঁজে পাইনি। তার উদ্ভ্রান্ত পাগলপ্রায় চেহারার দিকে তাকানো যায় না।’