নোনাপানিতে ডুবে আছে সব, সংকট খাওয়ার পানির

নোনা পানিতে ডুবে আছে পুকুর। নারীদের খাবার পানি আনতে হয় কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে। সোমবার খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ ঘুগরাকাটি গ্রামে
 ছবি: শেখ আল-এহসান

খুলনার কয়রায় বাগালী ইউনিয়নের ঘুগরাকাটি-হোগলা সড়কের দক্ষিণ ঘুগরাকাটি গ্রামে সেতুর পাশ দিয়ে ইট বিছানো একটি সড়ক চলে গেছে কলাপোতা গ্রামে। সড়কের দুই পাশের বাড়িঘর তলিয়ে আছে পানিতে। সড়কের কোথাও কোথাও প্রায় কোমরসমান পানি।

সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওই সড়ক ধরে পানির কলস কাঁকে কলাপোতা গ্রামে নিজের বাড়ি ফিরছিলেন তপতী মণ্ডল, শীলা রানী সরকারসহ আরও কয়েকজন নারী। কলসভর্তি খাওয়ার পানি। প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরের হোগলা গ্রামের একটি নলকূপ থেকে পানি এনেছেন তাঁরা। ওই এক কলস পানিই চারজনের পরিবারের এক দিনের সম্বল।

তপতী মণ্ডল বললেন, আগে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের বাগালী সরকারি পুকুর থেকে খাওয়ার পানি আনতেন। কিন্তু নোনাপানিতে ওই পুকুর ভরে গেছে। এলাকায় যে নলকূপ আছে, সেই পানিতে আর্সেনিক ও আয়রন, তা–ও নোনাপানিতে তলিয়ে আছে। দুদিন ওই পানি খেয়ে পেটের অসুখ হয়েছে। তাই এখন হোগলা থেকে পানি আনছেন।
শীলা রানী সরকার বলেন, এক কলস পানি দিয়েই এক দিন চলতে হবে। এ কারণে পানি কম খেতে হয়। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।

তপতী মণ্ডল ও শীলা রানী সরকারের মতো খাওয়ার পানির সংকটে আছেন কয়রা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ২৬ গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। খাবার সংকটেও রয়েছেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে বাগালী ও পাশের মহারাজপুর ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম রয়েছে। ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ওই গ্রামগুলো প্লাবিত হয়েছে। এখনো ওই সব গ্রামের মধ্য দিয়ে নিয়মিত জোয়ারভাটা আসা-যাওয়া করছে। পাঁচ দিন ধরে এভাবেই চলছে। অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধ ও উঁচু স্থানে। যাঁরা ঘরে থাকছেন, তাঁরা জোয়ার-ভাটার সময় মিলিয়ে রান্না করছেন।

সোমবার বাগালী ও মহারাজপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি এলাকাই ডুবে আছে নোনাপানিতে। কালচে হয়ে গেছে পানি। এখানে–সেখানে মরে আছে মাছ। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বের হচ্ছে তা দিয়ে। পানির তোড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে সড়ক। ইটের রাস্তাগুলোর ইট উঠে গেছে। পিচের রাস্তায় তৈরি হয়েছে বড় বড় ক্ষত। বিভিন্ন এলাকায় পানি আটকে রাখতে সড়কের ওপর রাখা হয়েছে মাটি ও বালুর বস্তা।
কয়েকটি গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই দুই ইউনিয়নের মানুষ কোনো খাদ্যসহায়তা পায়নি। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। খাওয়ার পানির পাশাপাশি সংকট তৈরি হয়েছে শৌচাগার নিয়েও।

এসব গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, ঘরের মধ্যে ইট দিয়ে উঁচু করে চুলা তৈরি করে তাতে রান্না করতে হচ্ছে তাঁদের। এক বেলা খেলে আরেক বেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। কাজ না থাকায় এলাকার মানুষের আয়ের পথও বন্ধ। অন্য এলাকায় যে কাজে যাবেন, তারও উপায় নেই।

মহারাজপুর ইউনিয়নের মেগের আইট গ্রামে নিজের বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন আলাউদ্দিন সরদার। ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা তিনটা। পরনের লুঙ্গি কাছা দিয়ে হাঁটুসমান পানি পার হয়ে সড়কে ওঠেন আলাউদ্দিন। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ঘরের মধ্যেই হাঁটুপানি, রান্নার জায়গা নেই। কয়েক দিন আগে আত্মীয়ের বাড়ি থেকে শুকনা খাবার পাঠানো হয়েছিল, সেটা দিয়েই চলছে। সরকারিভাবে কোনো খাদ্যসহায়তা পাননি।

খাওয়ার পানির সংকট ও অপ্রতুল ত্রাণের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করছে উপজেলা প্রশাসনও। জানতে চাইলে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনিমেশ বিশ্বাস বলেন, আগ থেকেই পানির সংকট ছিল। বেশির ভাগ মানুষ পুকুরের পানি পান করতেন। ইয়াসের প্রভাবে কিছু কিছু খাওয়ার পানির পুকুর নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট দিয়ে পানির সংকট আছে এমন এলাকায় পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ইউএনও আরও বলেন, সরকারিভাবে যে ত্রাণ ও অর্থসহায়তা পাওয়া গিয়েছিল, তা সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।