উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার বড় নদ-নদীগুলোর পানি বাড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে খালিয়াজুরী উপজেলার ধনু নদে হঠাৎ পানি বাড়ায় হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান নিয়ে শঙ্কায় আছেন স্থানীয় কৃষকেরা। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, পানি বাড়তে থাকলে ২০১৭ সালের মতো অকালবন্যায় ফসল হারাতে হবে।
স্থানীয় কৃষক, উপজেলা প্রশাসন, কৃষি বিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, নেত্রকোনার খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন মূলত হাওরাঞ্চল। হাওরের একমাত্র ফসল বোরোর ওপরই নির্ভর করে কৃষকদের সারা বছরের সংসার খরচ, চিকিৎসা, সন্তানদের পড়ালেখা ও আচার-অনুষ্ঠান। জেলায় ছোট-বড় মোট ১৩৪টি হাওরের মধ্যে খালিয়াজুরীতে ৮৯টি হাওর আছে। হাওরাঞ্চলে ৩০০ কিলোমিটার ডুবন্ত (অস্থায়ী) বাঁধের মধ্যে খালিয়াজুরীতে ১৮১ কিলোমিটার, মোহনগঞ্জে ৬১ কিলোমিটার ও মদনে ৪৬ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার ডুবন্ত বাঁধ আছে। ওই বাঁধের ওপর স্থানীয় কৃষকদের প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ফসল নির্ভর করে। হাওরের ফসল রক্ষায় এ বছর পাউবো উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রায় ৩৩ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে বাঁধ নির্মাণ করেছে।
কিন্তু গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ভারতের চেরাপুঞ্জি এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাত হয়। এই দুই দিনে ৫৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এতে পাহাড়ি ঢলের কারণে নেত্রকোনার নদ-নদীর পানি বাড়ছে। গত শুক্রবার থেকে আজ রোববার সকাল ৯টা পর্যন্ত খালিয়াজুরীর ধনু নদে প্রায় সাড়ে চার ফুট পানি বেড়েছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহন লাল সৈকত প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধনু নদে পানি বাড়ায় খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। এর মধ্যে ফসল রক্ষা বাঁধের বাইরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করেছে। তবে নদের পানি এখনো বিপৎসীমার নিচে আছে। নদের খালিয়াজুরী পয়েন্টে বিপৎসীমা ৪ দশমিক ১৯ সেন্টিমিটার। কিন্তু সেখানে আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত ৩ দশমিক ৭১ সেন্টিমিটার পানি আছে। উপজেলা প্রশাসনকে নিয়ে আমরা এলাকায় অবস্থান করছি। ফসল রক্ষা বাঁধ রক্ষায় আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে।’
স্থানীয় কয়েক কৃষক বলেন, খালিয়াজুরীর লক্ষ্মীপুর, চুনাই হাওর, বাইদ্যার চর, কাটকাইলের কান্দা ও কীর্তনখোলা হাওরের বেড়িবাঁধের বাইরের অংশ তলিয়ে গেছে। তবে এখনো কোনো ফসল রক্ষা বাঁধ ভাঙেনি। পানি বাড়তে থাকলে বাঁধ ভেঙে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা। খালিয়াজুরীর গাজিপুর ইউনিয়নের পাঁচহাট এলাকার মিজাজুল মিয়া বলেন, বৈলং হাওরের বেড়িবাঁধের বাইরের এলাকা তলিয়ে গেছে। আরেকটু পানি বাড়লে বেড়িবাঁধ ভেঙে হাওরের ফসল তলিয়ে যাবে।
পাঁচহাট গ্রামের কৃষক নুর মোহাম্মাদ বলেন, ‘ফসল রক্ষা বাঁধের বাইরে আমাদের কয়েক কৃষকের প্রায় ২০ একর আধা পাকা ধান তলিয়ে গেছে। সারা বছরের একমাত্র ফসল চোখের সামনে তলিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কিছুই করার নেই। হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ হয়েছে। কিন্তু কৃষি বিভাগ থেকে আগাম জাতের ধানের চাষের পরামর্শ দিলে এমন ক্ষতি হতো না।’
নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এফ এম মোবারক আলী বলেন, ‘হাওরাঞ্চলে কিছু এলাকায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। আর দুই সপ্তাহ পর পুরোদমে হাওরে ফসল কাটা শুরু হবে। তবে আগাম বন্যার জন্য খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছি। আমরা চাষিদের আগাম জাতের ধান লাগানোর পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু অনেকেই অধিক ফলনের আশায় আগাম জাতের ধান কম লাগান।’
খালিয়াজুরীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার থেকে ধনু নদে পানি বাড়তে শুরু করে। ভারতে চেরাপুঞ্জিতে বৃহস্পতিবার ১৯১ মিলিমিটার ও শুক্রবার ৩৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এর প্রভাব ধনু নদে পড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ফসল রক্ষা বাঁধ ভাঙেনি। কিন্তু নিম্নাঞ্চল কিছুটা প্লাবিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাশাপাশি আমরা বাঁধের পিআইসি কমিটির সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কৃষকদের সতর্ক থাকতে বলেছি। যেখানে জিও ব্যাগ ফেলার দরকার, সেখানে তা প্রস্তুত রেখেছি। পানি বাড়লে ঝুঁকি বাড়বে, সে ক্ষেত্রে সবার সতর্ক থাকতে হবে।’