নেত্রকোনার ৩৫টি পাহাড়ি গ্রামে গারোরা পানির কষ্টে

নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার পাহাড়ি গ্রামগুলোতে পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে খাওয়ার পানির তীব্র সংকট। তাই বাধ্য হয়ে ছড়া বা কূপ থেকে পানি সংগ্রহ করছেন শিশু ও নারীরা। সম্প্রতি রংছাতি ইউনিয়নের চন্দ্রডিঙ্গা এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার পাহাড়ি গ্রামগুলোতে শুকনো মৌসুমে পানির সংকট পুরোনো। কিন্তু এবারের দাবদাহে সেই সংকট আরও বেড়েছে। পাহাড়ে প্রায় প্রতিটি ঘরে এখন বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির জন্য হাহাকার চলছে। পাহাড়ি ছড়ার (নালা) ময়লাযুক্ত পানি অথবা টিলার নিচে তিন চাকের তৈরি অগভীর কূপের ঘোলা পানিই তাঁদের ভরসা।

স্থানীয় বাসিন্দা ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, কলমাকান্দার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে লেংগুরা, খারনৈ ও রংছাতি ইউনিয়ন মূলত পাহাড়ি এলাকা। এসব এলাকায় প্রধানত গারো ও হাজং সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। প্রায় ৩৫টি গ্রামে পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রামের বাসিন্দারা সাধারণত ছড়া, খাল ও কুয়ার পানির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু চলমান তীব্র দাবদাহে সেগুলোও শুকিয়ে যাওয়ায় সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন গ্রামগুলোর ১৮ হাজার মানুষ। অনেক পাহাড়ি গ্রামে পানির অভাবে দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হচ্ছে। গভীর নলকূপ না থাকার কারণেই সুপেয় পানির জন্য অনেকেই এক থেকে দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়।

আটটি ইউনিয়নের মধ্যে লেংগুরা, খারনৈ ও রংছাতি ইউনিয়ন মূলত পাহাড়ি এলাকা। এসব এলাকায় প্রধানত গারো ও হাজং সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস।

সম্প্রতি সরেজমিনে রংছাতি ইউনিয়নের চন্দ্রডিঙ্গা, পাচগাঁও, সন্ন্যাসীপাড়া, জাকিরপাড়া ও মনগড়া গ্রামে খাবার পানির জন্য হাহাকারের কথা জানা যায়। নারীরা কাঁখে বা মাথায় কলসি নিয়ে দূর থেকে পানি সংগ্রহ করছেন। এক গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামে গিয়ে গোসল করছেন।

চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের গৃহিণী আরতী মারাক বলেন, তাঁর বাড়িতে একটি অগভীর নলকূপ আছে। কিন্তু প্রায় তিন মাস ধরে তাতে পানি আসে না। বাধ্য হয়ে প্রতিদিন তিনি এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পাশের গ্রাম থেকে সকাল ও বিকেলে পানি সংগ্রহ করেন। এ দিয়েই রান্নাবান্না, খাবারসহ সব চলে। পানির জন্য খুবই কষ্ট করতে হচ্ছে।

কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুল হাসেম বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এই সমস্যা প্রকট হচ্ছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, দ্রুত প্রয়োজনীয় সমাধান মিলবে।

খারনৈ ইউনিয়নের কচুগড়া গ্রামের সন্তোষ সাংমা। তিনি দরিদ্র মানুষ। তাঁর বাড়িতে নলকূপ না থাকায় খাবার পানির জন্য সারা বছরই কষ্ট করতে হয়। সন্তোষ বলেন, মানুষের বাড়িতে গিয়ে অনেক দূর থেকে পানি আনতে হয়। এখন ঝরনার পানিও আসে না। খালে পানি শুকিয়ে গেছে। গোসল, থালাবাসন ধোয়া, গরু-ছাগল গোসল করানোসহ তাঁদের খাওয়ার পানির সংকট চরমে পৌঁছেছে। বিশ্বনাথপুর, রানীগাঁও, খারনৈ, গোবিন্দপুরসহ আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের শুকনা মৌসুমে পানির জন্য কষ্ট করতে হয়। সরকারিভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলে এলাকার মানুষের উপকার হতো।

লেংগুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ওবায়দুল হক ভূঁইয়া বলেন, চেংগ্নী, গোপালবাগি, ফুলবাড়ি, কালাপানি, কাঁঠাবাড়িসহ প্রায় ১৪টি গ্রামে খাবার পানি সংকট আছে। খারনৈ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ওবায়দুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামগুলোতে পানির জন্য দুর্ভোগের বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি কী করা যায়। এসব জায়গায় প্রায় হাজার ফুটের বেশি গভীর নলকূপ বসাতে হবে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সরাসরি উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিলেই কেবল দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই গ্রামগুলোতে পানির সমস্যা নিরসন করা সম্ভব হবে।’

সরকার সব উন্নয়ন করছে, কিন্তু গারোদের পানির দুঃখ দূর করছে না বলে মন্তব্য করেন চেংগ্নী গ্রামের বৃদ্ধ নারী মায়া রেমা। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারলেন না, এটা দুঃখ।

লেংগুরা ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকায় বেশ কিছু গভীর কূপ সরকারিভাবে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন কলমাকান্দা উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, পাহাড়ি এলাকায় পাথরের জন্য নলকূপ বসানো সম্ভব হয় না। বেশ কিছু রিংওয়েল বসানোর কাজ চলছে। অন্য এলাকাগুলোতেও তা করা হবে।

জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসান হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলে বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য গভীর নলকূপ স্থাপনের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। অচিরেই এসব অঞ্চলে পানির সমস্যা দূর করা হবে।