নিয়োগপ্রাপ্তদের চাকরি ‘টিকবে কি টিকবে না’ তা নিয়ে আলোচনা

নিয়োগ নিয়ে গতকাল দিনভর ক্যাম্পাসে হুলুস্থুল কাণ্ড হয়ে গেলেও আজ শুক্রবার সকালের শুরুটা হয়েছে নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে।
ছবি: প্রথম আলো

‘অনেক দিন ধরে প্রত্যাশা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চাকরি হবে। সে জন্য লেগেও ছিলাম। চাকরিও হলো। তবে চাকরির নিরাপত্তা কে দেবে সেই চিন্তায় রয়েছি।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের শেষ কর্মদিবসে নিয়োগপত্র পাওয়া একজন সাংবাদিক তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলছিলেন এসব কথা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব ধরনের নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও গতকাল বৃহস্পতিবার শেষ কর্মদিবসে রাজশাহীর চার সাংবাদিক, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মী, শিক্ষকদের আত্মীয়স্বজনসহ ১৪১ জনকে অ্যাডহকে (অস্থায়ী) শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই নিয়োগকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবৈধ ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিষয়টি নিয়ে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই খবরে আরও ভেঙে পড়েছেন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা।

নিয়োগ নিয়ে গতকাল দিনভর ক্যাম্পাসে হুলুস্থুল কাণ্ড হয়ে গেলেও আজ শুক্রবার সকালের শুরুটা হয়েছে নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে। আজ সকাল ৯টায় ক্যাম্পাসের শহীদ শামসুজ্জোহা চত্বর ও প্যারিস রোডে দেখা গেল পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের। তাঁদের অনেকের মুখেই উঁচুনিচু স্বরে আগের দিনের নিয়োগ নিয়ে আলাপ। কেউ বলছেন, ‘টিকবে কি? টিকবে না।’ কারও মন্তব্য, ‘এত কিছু করেও আটকাতে পারল?’ এর বাইরে ক্যাম্পাসে কেবল হাতে গোনা কয়েকজনকে দেখা গেল মোটরসাইকেল নিয়ে ও হেঁটে পথ চলতে।

আগের দিনের উপাচার্যের বাসভবনের গেটে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি। আজ সকালে তার কিছুই নেই। বৃহস্পতিবার দুপুরে উপাচার্য এম আবদুস সোবহান সপরিবার বাসভবন ছেড়ে গেছেন। বাসভবনের ভেতরে গেটের পাশে পাহারায় আছেন কেবল পুলিশের একজন সদস্য ও দুজন প্রহরী। বাসভবনের চত্বরে কাজ করছেন কয়েকজন মালি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী।
প্রহরী দুজন জানান, গতকাল উপাচার্য চলে যাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল শাখা বাসভবনের গেট বন্ধ করে দিয়েছে। এখন আর সেখানে কেউ নেই। কোনো দাপ্তরিক কাজও নেই বাসভবনে।

প্রধান ফটক, সিনেট ভবন, কাজলা গেট ও শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকের সামনে ছিলেন পুলিশের সদস্যরা। তবে সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের নিয়মিত টহল গাড়ির পাশাপাশি অতিরিক্ত একটি গাড়িকে দেখা গেল টহল দিতে।

উপাচার্যের শেষ কর্মদিবসে নিয়োগ নিয়ে বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসে হুলুস্থূল অবস্থার সৃষ্টি হয়

শুক্রবার হলেও সকালে খোলাই ছিল প্রশাসন ভবন। ভবনের গেটেও কেবল একজন প্রহরী। তিনি জানান, ভবনে সকালে কেবল সহ-উপাচার্যের দপ্তরে দু-একজন কর্মকর্তা ঢুকেছেন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রশাসন ভবনে প্রবেশ করেন উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য দপ্তরের আরও তিন-চারজন কর্মকর্তা। ৯টা ২০ মিনিটে গাড়ি নিয়ে প্রশাসন ভবনের সামনে এসে নামেন সহ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা। গতকাল তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পেয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র ও নিয়োগ তালিকায় দেখা যায়, নিয়োগ পাওয়া লোকজনের মধ্যে রয়েছেন ৯ জন শিক্ষক, ২৩ জন কর্মকর্তা, ৮৫ জন নিম্নমান সহকারী এবং ২৪ জন সহায়ক কর্মচারী। এঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তান, স্ত্রী ও স্বজন, ছাত্রলীগের সাবেক-বর্তমান নেতা-কর্মী, সাংবাদিক নেতাসহ চারজন সাংবাদিক রয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডহকে ছয় মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। ছয় মাস পর যদি ওই ব্যক্তি আবার চাকরি করতে চান, তখন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বিবেচনা করলে পুনরায় ছয় মাস বাড়বে, আর না বিবেচনা করলে তাঁর চাকরি সেখানেই শেষ।
মো. মখলেছুর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার

তাঁদের নিয়োগপত্রে বলা হয়েছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯৭৩ এর ১২ (৫) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিম্নলিখিত প্রার্থীদের তাঁদের নামের পাশে বর্ণিত পদ ও স্থানে অস্থায়ী ভিত্তিতে (অ্যাডহক) অনধিক ছয় মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হলো। এ নিয়োগ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করা হোক।’ এ ছাড়া নিয়োগপত্রে বলা আছে, প্রার্থীদের নিয়োগ যোগদানের দিন থেকে কার্যকর হবে।

সদ্য চাকরি পাওয়া বেশ কয়েকজনের সঙ্গে প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কথা হয়। তবে তাঁরা কেউই গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না। তাঁরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি জায়গায় চাকরি পেয়ে তাঁরা উপাচার্য আবদুস সোবহানের প্রতি কৃতজ্ঞ। একই সঙ্গে আবার অসন্তুষ্ট। তিনি তাঁদের নিয়োগকে স্থায়ীভাবে করে দিয়ে যেতে পারেননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগে থেকেই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। সেটাও তাঁরা মনে করেছিলেন একসময় উঠে যাবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁরা জানতে পারেন, আলাদাভাবে এই ১৪১ জনের নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করে তদন্ত কমিটি ঘোষণা করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ জন্য তাঁরা তাঁদের চাকরি স্থায়ী করতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে বেশ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তবে কেউ কেউ বলছেন, তাঁদের চাকরি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়েরর উপ-রেজিস্ট্রার মো. মখলেছুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডহকে ছয় মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। এই সময় শুরু হয় সংশ্লিষ্ট পদে যোগদানের দিন থেকে। ছয় মাস পর যদি ওই ব্যক্তি আবার চাকরি করতে চান, তখন তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বিবেচনা করলে পুনরায় ছয় মাস বাড়বে, আর না বিবেচনা করলে তাঁর চাকরি সেখানেই শেষ।

যদিও বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যাডহকে নিয়োগপ্রাপ্তদের পরবর্তী সময়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্থায়ী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার নজির রয়েছে।

চাকরি পাওয়া ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা বলেন, তাঁরা এখন যেভাবেই হোক চাকরি পেয়েছেন। তাঁদের এখন কাজ হচ্ছে চাকরিকে স্থায়ী করা। এটা তাঁদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। সামনে কে উপাচার্য হবেন, কোন প্রশাসন ক্ষমতায় আসে, তার ওপর নির্ভর করছে মূলত তাঁদের চাকরি। আপাতত তাঁরা চাকরি পাওয়ার আনন্দে থাকলেও ভেতরে চাপা কষ্ট রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম ফারুকী বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের নিয়োগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা ছিলই। উপাচার্যের বিরুদ্ধেও একাধিক অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাকে তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শেষ দিনে ১৪১ জনকে নিয়োগ দিয়ে গেলেন। এটাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবৈধ ঘোষণাও করেছে। এভাবে এই প্রক্রিয়ায় চাকরিপ্রাপ্তরা তো ঠিক থাকতে পারে না। তাঁদের অবশ্যই চাকরি স্থায়ীকরণের ব্যাপারে নিরাপত্তাহীনতা বা অনিশ্চয়তায় থাকার কথা। তিনি আরও বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সরকার উপাচার্যের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে বলে তিনি মনে করেন।