রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের ১৯ দিন পার হলেও খুনের ঘটনায় জড়িত মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশ এ পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে পাঁচ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন কক্সবাজার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। হুমকি-ধমকির কারণে মুহিবুল্লাহর পরিবার তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রে আশ্রয় চেয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কাছে সম্প্রতি আবেদন করেছে।
তবে আরআরআরসি বলছে, তারা এ ধরনের কোনো আবেদন পায়নি। বর্তমানে মুহিবুল্লাহর পরিবারের সদস্যদের আগের লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের ঠিকানা থেকে সরিয়ে উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে। সেখানে নিরাপত্তা জোরদার করেছে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে আটটায় উখিয়া লাম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের ডি ব্লকের আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের কার্যালয়ে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন মুহিবুল্লাহ (৪৮)। তিনি ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ঘটনার পর মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আরসার (আরাকান স্যালভেশন আর্ম) নেতা আবদুর রহমানের নেতৃত্বে অস্ত্রধারীরা পরপর পাঁচটি গুলি করে মুহিবুল্লাহকে হত্যা করে।
তবে পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়া থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ। এরপর হামলাকারীদের ধরতে অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
৩ অক্টোবর পর্যন্ত শিবিরের বিভিন্ন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পাঁচ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরপর দুই দফায় পাঁচ রোহিঙ্গাকে তিন দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে উখিয়া থানার পুলিশ। তাঁদের মধ্যে মো. ইলিয়াছ নামের একজন কক্সবাজার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ধরতে ক্যাম্পে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান চললেও মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
৯ অক্টোবর দুপুরে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন মুহিবুল্লাহর বসতিতে (ক্যাম্প) গিয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। এ সময় পররাষ্ট্রসচিব সাংবাদিকদের মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার কথা বলেন।
রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাঈমুল হক বলেন, মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য সন্ত্রাসীদের ধরতে সেখানে (ক্যাম্পে) রাত-দিন অভিযান চালানো হচ্ছে। তৃতীয় দেশে আশ্রয় চায় মুহিবুল্লাহর পরিবার
উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে থাকাকে নিরাপদ মনে করছে না মুহিবুল্লাহর পরিবার। প্রতিনিয়ত প্রাণনাশের হুমকি-ধমকিতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে পরিবারটি। তৃতীয় কোনো দেশে (বাংলাদেশ-মিয়ানমার ছাড়া) আশ্রয় চেয়ে ১০ অক্টোবর আরআরআরসির কাছে আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুহিবুল্লাহর পরিবারের সদস্যরা। রোববার আবেদন করার সত্যতা নিশ্চিত করেন মুহিবুল্লাহর ভাগনে (বোনের ছেলে) মোহাম্মদ রশিদুল্লাহ।
রশিদুল্লাহ বলেন, তাঁর মামার হত্যাকাণ্ডের পর থেকে মুঠোফোনে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা পরিবারের সদস্যদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। হুমকিদাতারা বলছে, হত্যার ঘটনা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে তাঁদেরও একই ধরনের পরিণতি ভোগ করতে হবে। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যসহ ঘনিষ্ঠ স্বজনেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুহিবুল্লাহ পরিবারের আরেক সদস্য বলেন, প্রাণনাশের হুমকিতে ঝুঁকিতে আছেন মুহিবুল্লাহর স্ত্রী, ভাই (মামলার বাদী) হাবিবুল্লাহ, চাচাতো ভাই নুরুল আমিনসহ ছয়টি পরিবারের অন্তত ৩০ জন। তাঁদের প্রতিনিয়ত মুঠোফোনে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীরা এ ধরনের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
মুহিবুল্লাহর ভাগনে রশিদুল্লাহ বলেন, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের হুমকি দেওয়ার বিষয়টি তাঁরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প প্রশাসন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ (এপিবিএন) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছেন। এরপরই পরিবারের আট সদস্যসহ নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা ছয়টি পরিবারের সদস্যদের লম্বাশিয়া ক্যাম্প থেকে শনিবার অন্যত্রে সরিয়ে নেওয়া হয়। এখন তাঁরা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নিরাপদে আছেন।
পরিবারের সদস্যরা বলেন, পুলিশ পাহারায় এভাবে কত দিন থাকা যায়, এ কারণে তাঁরা তৃতীয় কোনো দেশে আশ্রয় চান। সেখানে নিরাপদে নিশ্বাস নেওয়া যাবে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কাছে করা আবেদনে তাঁদের পছন্দের দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত আরআরআরসি কার্যালয় থেকে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি।
এ প্রসঙ্গে আরআরআরসি শাহ মো. রেজওয়ান হায়াত বলেন, নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ স্বজনদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো লিখিত আবেদন পাননি তিনি। যদি তাঁদের কাছ থেকে এ ধরনের কোনো আবেদন পাওয়া যায়, বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।