নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন জীবন

এ বছর ফৌজিয়া রাজশাহী বিভাগের জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। পেয়েছেন আরও নানা সম্মাননা।

ফৌজিয়া হক

ফৌজিয়া হক পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। সেই স্বামীই যৌতুকের জন্য নির্যাতন শুরু করেন। এইচএসসি পরীক্ষার আগে তাঁর মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করেন। এই দুরবস্থার মধ্যে পরীক্ষা দিয়েও তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেছিলেন। এরপর ভর্তি হন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনো তাঁর স্বামী তাঁকে গাছের ডাল দিয়ে মারধর করেন। চিকিৎসার পর সুস্থ হলেও তিনি বাঁ কানে শুনতে পান না এবং বাঁ চোখে কম দেখেন।

তারপরও থামেনি নির্যাতন। পরীক্ষার সময়েও স্বামী তাঁকে অপহরণের চেষ্টা করেন। এই প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি এবার রাজশাহী বিভাগের জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। সমাজসেবায় অবদানের জন্য পেয়েছেন আরও অনেক সম্মাননা। ফৌজিয়া এখন বগুড়ার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

আজ ২৬ জুন আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবস। শত নির্যাতনেও পিছু না হেঁটে সংগ্রামে জয়ী হওয়ার গল্পটা সবার মধ্যে প্রেরণা জোগাবে, এটাই ফৌজিয়ার চাওয়া।

ফৌজিয়া হকের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলায়। ফৌজিয়া বলেন, তাঁর বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। বিয়ের পরই যৌতুকের জন্য নির্যাতন শুরু হয়। এইচএসসি পরীক্ষার আগে তাঁর মাথায় তাঁর স্বামী ইট দিয়ে মেরে ঘরে তালা দিয়ে রাখেন। পরে সেখান থেকে প্রতিবেশীরা তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। এত সমস্যার পরও তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেন।

এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তাঁর স্বামী ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই তাঁর স্বামী তাঁকে গাছের ডাল দিয়ে বেধড়ক মারধর করেছিলেন। এতে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রক্তাক্ত অবস্থায় সহপাঠীরা তাঁকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সুস্থ হলেও তিনি বাঁ কানে আর শুনতে পান না। বাঁ চোখে কম দেখেন।

এ ঘটনার প্রতিবাদে সহপাঠীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল বের করেছিলেন। একপর্যায়ে তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর স্বামীকে বহিষ্কার করে। এরপরও নির্যাতন থামেনি। পরীক্ষার সময় তাঁকে অপহরণ করার চেষ্টা করা হয়। এ তীব্র প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই ২০০১ সালে তিনি সমাজবিজ্ঞান থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। তার আগের বছরই তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগদান করেন।

ফৌজিয়া বলেন, পড়াশোনা শেষ করে নতুনভাবে জীবন গড়ার শপথ নেন। সব ভুলে আবার সামনে এগিয়ে যান। এক আইনজীবী রাজ্জাকুল কবিরের সঙ্গে নতুন করে ঘর বাঁধেন। স্বামীর সঙ্গে তিনি সমাজসেবামূলক কাজ শুরু করেন। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে হ্যান্ডস্যানিটাইজার ও মাস্ক বিতরণ করেন। বিধিনিষেধের মধ্যে মানুষের বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেন। এ জন্য উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তিনি সম্মাননা পান।

এ বছর ফৌজিয়া ‘নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোগে জীবন শুরু করেছেন যে নারী’ শাখায় রাজশাহী বিভাগের জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক কার্যক্রমের আওতায় এ সম্মাননা দেওয়া হয়। গত এপ্রিল মাসে তিনি ‘রাঁধুনী কীর্তিমতি’ সম্মাননা পেয়েছেন। ২০২১ সালে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-আইপিডিসি ফাইন্যান্স তাঁকে ‘আনসাং উইমেন ন্যাশন বিল্ডারস অ্যাওয়ার্ড’ দেয়।

ফৌজিয়া তাঁর বন্ধুর পথ অতিক্রম করা নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। তাই সয়েছি অনেক ঝড়। আমার রক্ত দিয়ে রইবে লেখা এক ইতিহাসের ঘর।’