নির্বিচারে মারা পড়ছে মাছ

চিংড়ির রেণুগুলো আলাদা করে অন্য প্রজাতির মাছের পোনা, মাছের ডিম ফেলে দেওয়া হচ্ছে নদীর পাড়ে।

মশারির জাল দিয়ে ধরা হচ্ছে রেণু ও গলদা পোনা। সম্প্রতি পাথরঘাটার কালমেঘা ইউনিয়নে বিষখালী নদীতে

বরগুনার পায়রা, বলেশ্বর ও বিষখালী নদীতে ছয় শতাধিক স্থানে নির্বিচার বাগদা ও গলদা চিংড়ির পোনা শিকার করছেন স্থানীয় অসাধু জেলেরা। পোনা শিকারে ব্যবহার করা হচ্ছে নিষিদ্ধ মশারি জাল। চিংড়ি পোনা শিকারের সময় নির্বিচার মারা পড়ছে অন্যান্য মাছ ও জলজ প্রাণীর পোনা। প্রতিবছর চৈত্র থেকে আষাঢ় পর্যন্ত চলে এ অবস্থা। কোনোভাবেই তা রোধ করা যাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে নদীগুলো একসময় মাছশূন্য হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।

বরগুনার পাথরঘাটার কালমেঘা, বরইতলা, বাইনচটকি, লালদিয়া এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বিষখালী নদীতে প্রায় ১০ হাজার জেলে মশারি জাল টানছেন। এসব জালে আটকে থাকে গলদা ও বাগদা চিংড়ির পোনাসহ নানা প্রজাতির মাছ এবং জলজ প্রাণী ও মাছের অংখ্য ডিম। নারী ও শিশুরা রেণু-মাছ-ডিম রাখার পাত্র থেকে চিংড়ির রেণুগুলো আলাদা করে অন্যান্য প্রজাতির মাছের পোনা, মাছের ডিম ও জলজ প্রাণী ফেলে দিচ্ছেন নদী পাড়ে। ফলে মারা পড়ছে এসব। এর মধ্যে রয়েছে পোয়া, ট্যাংরা, গুলশা, তপসে, ফাইসা, ফ্যাহাসহ নানা প্রজাতির মাছের পোনা।

রেণু শিকার করা জেলে জহির মিয়া বলেন, ‘এখন পোনা মাছ ধরার গোন (মৌসুম)। চৈত্রের শুরু থেকে আষাঢ় পর্যন্ত রেণু পোনা শিকার করে থাকি। সপ্তাহে আমরা রেণু পোনা শিকার করে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা আয় করি। দূরদূরান্তের ব্যবসায়ীরা ট্রাক নিয়ে রেণু কিনতে আসেন। যার কাছে বেশি দাম পাওয়া যায়, তার কাছেই রেণু বিক্রি করি। বাগদার পোনা ৩০০ টাকা দরে। আর গলদার পোনার দাম কম হওয়ায় এই পোনার শত বিক্রি হয় ৭০-৮০ টাকা দরে।’

পাথরঘাটা উপজেলার কূপধোন গ্রামের খলিলুর রহমান বলেন, প্রতিদিন পোনা শিকার করে গড়ে প্রায় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা আয় হয়। বছরের চার মাস তাঁরা এই পোনা শিকার করেন। অন্যান্য মাছের পোনা-ডিমসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মারা যাওয়া বিষয় তিনি বলেন, ‘একটু লাভ করতে চাইলে একটু ক্ষতি হবে, এটা আমরা জানি, কিন্তু এই দিয়েই আমাদের সংসার চলে।’

বরগুনা সদরের গুলবুনিয়া, চেয়ারম্যান বাজার, পুরাকাটা, ডালভাঙ্গা, তালতলীর জয়ালভাঙ্গা, শুভসন্ধ্যা, সোনাকাটা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, হাজার হাজার জেলে ও তাঁদের পরিবারের লোকজন চিংড়ির পোনা শিকার করছেন অবাধে। প্রশাসনের লোক এলে তাঁরা জাল তুলে ফেলেন। তাঁরা চলে গেলে আবার শুরু হয় রেণু শিকার। বিষয়টি স্বীকার করে বরগুনা সদর উপজেলার ডালভাঙ্গা গ্রামের জেলে আনিছুর রহমান বলেন, সাগরে মাছ ধরে যে আয় হয়, তার থেকে বেশি আয় হয় এই চার মাস পোনা শিকার করে। অনেক জেলেই এই সময়ে সাগরে না গিয়ে রেণু শিকার করেন।

চিংড়ির রেণু পোনা ব্যবসার সঙ্গে একসময় সম্পৃক্ত ছিলেন জাহাঙ্গীর হোসেন জোমাদ্দার। তিনি বলেন, শুধু পাথরঘাটা উপজেলার তিনটি পয়েন্টে রেণু পোনা বেচাকেনা হয়। এক মৌসুমে পাথরঘাটা উপজেলায় ২০ থেকে ২৫ কোটির মতো রেণু পোনা বিক্রি হয়। এ ছাড়া জেলার অন্যান্য উপজেলায় এর চেয়ে বেশি রেণু বিক্রি করা হচ্ছে।

বরগুনায় এক মৌসুমে কী পরিমাণ চিংড়ির রেণু ধরা হয়; বিপরীতে অন্য মাছের পোনা কী পরিমাণ মারা পড়ে—এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, ‘বাগদা ও গলদা রেণু পোনা শিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আশা করছি, এক সপ্তাহের মধ্যে বরগুনার প্রধান তিনটি নদীতে কোনো মশারি জাল থাকবে না।’

পাথরঘাটা কোস্টগার্ডের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার জমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বরগুনা প্রধান তিন নদী ও সাগর মোহনায় অবৈধ মশারি জাল দিয়ে অসাধু জেলেরা গলদা ও রেণু পোনা শিকার করছেন। এসব বন্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। সম্প্রতি অভিযোগ চালিয়ে পাচারকারীরা ২৭ লাখ বাগদা–গলদা রেণু জব্দ করা হয়। পরে পোনাগুলো নদীতে অবমুক্ত করা হয়।