সরবরাহ বাড়ায় নানা অজুহাতে কারখানাগুলো কাঁচা চা–পাতার দাম কম দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ চাষিদের।
পঞ্চগড়ের নর্থ বেঙ্গল সেন্ট্রাল টি ইন্ডাস্ট্রিজে গত শুক্রবার দুপুরে ৫ হাজার ৪৯০ কেজি কাঁচা চা–পাতা সরবরাহ করেছিলেন চা–চাষি আলমগীর কবীর। তখন তাঁকে দাম কম বা কর্তনের বিষয়ে কিছুই জানায়নি কারখানা কর্তৃপক্ষ। পরদিন তাঁকে ৪ হাজার ৪৪৮ কেজি কাঁচা চা–পাতার দাম পরিশোধ করা হয় ১৩ টাকা ৩১ পয়সা কেজি দরে। সরবরাহ করা চা–পাতার মধ্য থেকে ১৯ শতাংশ কর্তন বা বাদ দেখানো হয়েছে।
জেলা কাঁচা চা–পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভায় প্রতি কেজি কাঁচা চা–পাতার সর্বনিম্ন মূল্য ১৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। মান অনুযায়ী, কেউ চাইলে এর বেশি দামেও পাতা কেনাবেচা হতে পারে। আর পাতা বৃষ্টিতে ভেজা হলে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কর্তন করতে পারবেন বলে গত বুধবার অনুষ্ঠিত ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত না মেনে চলতি মৌসুমে পঞ্চগড়ের চা–কারখানাগুলো নির্ধারিত দামে পাতা কিনছে না বলে অভিযোগ করছেন চাষিরা।
কারখানার মালিকেরা বলছেন, নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক পাতা আসা, নির্ধারিত সাড়ে চার পাতার বদলে ডালপালাসহ পুরোনো পাতা ও ভেজা পাতা সরবরাহ করায় কর্তন এবং কম দামে পাতা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। বাজারের এমন অবস্থার জন্য মধ্যস্বত্বভোগী বা ফড়িয়াদের দুষছেন চাষিরা। তাঁরা বলছেন, পাতা বেশি কেনা হয়ে গেছে বা পাতার মান খারাপসহ নানা অজুহাত দিয়ে কম দামে চা–পাতা কেনার কৌশল নিয়েছেন কারখানার মালিকেরা। পাতা কিনতে অনীহা দেখিয়ে কেনার সময় ২০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পাতা বাদ (কর্তন) দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে অনেককে পাকা রসিদও দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ চাষিদের।
গত রোববার পঞ্চগড়ের বিভিন্ন চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা ঘুরে দেখা যায়, কারখানাগুলোর সামনে পাতা নিয়ে আসা গাড়িগুলো দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো কারখানা মূল্য নির্ধারণ না করেই চাষিদের অনুরোধে পাতা তালিকাভুক্ত করে রেখে দিচ্ছে। আবার কোনো কারখানা ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত কেনা হয়ে গেছে জানিয়ে পাতা ফেরত দিচ্ছে। এ সময় অনেক চা–চাষি ও ফড়িয়া উপায় না পেয়ে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাদ দিয়েই চা–পাতা সরবরাহ করছেন।
সদর উপজেলার হাড়িভাসা এলাকার চা–চাষি আদর আলী বলেন, একটি কারখানায় ২ হাজার ৫০০ কেজি কাঁচা চা–পাতা দেওয়ার সিরিয়াল নিয়েছেন। শনিবার রাত ১২টায়ও মুঠোফোনে কারখানা কর্তৃপক্ষ পাতা নেবে বলে জানিয়েছে। রোববার সকালে ১ হাজার ২০০ কেজি পাতা নিয়ে এসেছেন। বেলা দেড়টা পর্যন্ত বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, পাতা কিনবে কি না কিছুই বলছে না কারখানা কর্তৃপক্ষ।
জেলা চা–চাষি অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি সায়েদ আলী বলেন, চাষিদের কাছ থেকে পাতা নিতে না চাইলেও ফড়িয়াদের কাছ থেকে ঠিকই পাতা কিনছে কারখানাগুলো। অনেক সময় ফড়িয়ারা পাতায় পানি মেশানোর কারণে চাষিদের বদনাম হচ্ছে। ফড়িয়ারা কিছু চাষিকে আগেই টাকা দিয়ে রাখে। পরে পাতা নেবে নেবে করে দেরি করানোয় বাগানে পাতা বড় হয়ে যাচ্ছে।
নর্থ বেঙ্গল টি ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তাঁরা ধারণক্ষমতার বেশি কাঁচা পাতা কিনে ফেলেছেন। কারখানাতেও কাঁচা চা–পাতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চাষিরা না বুঝেই বড় ডালপালাসহ পাতা নিয়ে আসছেন। অনেকের পাতা থেকে অনবরত পানি ঝরছে। বর্তমানে দ্বিতীয় পর্বের পাতার উৎপাদন কিছুটা বেশি। এ জন্য এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ২৫ মের মধ্যে চলতি পর্বের শেষ হলে নির্ধারিত মূল্যেই চা–পাতার দাম পরিশোধ করতে পারবেন।
প্রতিবছর মার্চ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত চা উৎপাদনের মৌসুম। এক মৌসুমে সাত পর্বে পাতা ওঠে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চা–পাতা সংগ্রহ ও কারখানাগুলোতে চা উৎপাদন বন্ধ থাকে। এ সময় চাষিরা তাঁদের বাগান প্রুনিং করে থাকেন।
পঞ্চগড় চা–পাতা মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, কারখানার মালিকেরা নির্ধারিত দরেই চা কিনবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে তাঁরা শুধু পাতা কিনে রাখছেন এবং পরে মূল্য পরিশোধ করবেন বলে জানিয়েছেন। তবে দ্বিতীয় পর্বে পাতার উৎপাদন বেশি হওয়ায় কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। চাষিদের সংকট নিরসনে একটি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে।