আকাশে কালো মেঘ। চারদিকে বইছে বাতাস। এখনই হয়তো বৃষ্টি নামবে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রের মাঠে খোলা আকাশের নিচে গরুগুলোকে পানির সঙ্গে খড় মিশিয়ে খাওয়াচ্ছিলেন বাশিক মিয়া (৪৬)। এই কাজে সহযোগিতা করেন তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের অপর এক নারী সদস্য।
আজ শুক্রবার সকালে এমন চিত্র দেখা যায় হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলা সদরে অবস্থিত বীর চরণ সরকারি পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে। বন্যার কারণে বাশিক মিয়ার মতো এখানে ২৭৬ জন নারী-পুরুষ ও শিশু আশ্রয় নিয়েছে।
বিদ্যালয়ের বারান্দায় গরুগুলোকে কোনোরকমে গাদাগাদি করে বেঁধে রেখেছেন বাশিক মিয়া। বারান্দার পাশেই ঠাঁই নিয়েছে বানভাসি মানুষ। বাশিক মিয়ার বাড়ি আজমিরীগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উঠেছেন আজমিরীগঞ্জ উপজেলা সদরে অবস্থিত বীর চরণ সরকারি পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে। তাঁর মতো এখানে আরও ২৭৬ জন নারী-পুরুষ ও শিশু আশ্রয় নিয়েছে। ১৮ জুন রাতে বাশিক মিয়ার বাড়িতে পানি ওঠে। এক দিনেই ঘরের মেঝে ৪ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে পরের দিন পরিবারের সদস্য ও গবাদিপশু নিয়ে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেন।
বন্যার কারণে এই সমস্যা শুধু বাশিক মিয়ার একার নয়, গরু, ছাগল, হাঁস ও মুরগি নিয়ে অসংখ্য লোক একই বিপদে পড়েছেন। অনেকে উঁচু এলাকায় স্বজনের বাড়িতে গরু-ছাগল পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বাশিক মিয়ার পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১২। তাঁর গরু আছে ছোট-বড় মিলিয়ে ৯টি। তিনি বলেন, প্রথম যখন আশ্রয়কেন্দ্রে গরুগুলো নিয়ে আসেন, তখন প্রশাসন ও আশ্রয়কেন্দ্রের অন্যরা বাধা দেন। পরে তাঁর অনুরোধে গরুগুলোরও কোনোমতে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই হয়। দিনের বেলায় বিদ্যালয়ের বারান্দায় গরুগুলো বেঁধে রাখেন। রাত হলে চোরের ভয়ে গরু ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা একই কক্ষে থাকেন।
শুক্রবার সকালে আশ্রয়কেন্দ্রে বাশিক মিয়ার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘নিজে খাই আর না খাই, গরুটাইনরে তো বাঁচানো লাগব। এখন মানুষ বাঁচব, না গরু বাঁচব, ইটা লইয়া চলছে সংগ্রাম। আজ সকালে অনেক জায়গায় গেছি গরুর জন্য ঘাস আনতে। চারপাশে পানি, কোথাও ঘাস কাটার সুযোগ নাই। বাড়ি থেকে আসার সময় কিছু ধানের খ্যাড় (খড়) আনছিলাম। তা দিয়া সকাল-দুপুর চলব। বিকেলে কী খাওয়ামু, তা নিয়ে চিন্তায় আছি।’
কোরবানি উপলক্ষে গত কার্তিক মাসে ৯টি ছোট আকারের ষাঁড় কেনেন বাশিক মিয়া। এতে তাঁর বিনিয়োগ সাড়ে চার লাখ টাকা। অনেক বছর ধরেই গরুর ব্যবসা করেন তিনি। ছয় থেকে সাত মাস লালনপালন করে ষাঁড়গুলো বড় করেন। তারপর কোরবানির ঈদের সময় তা বিক্রি করে মুনাফা করেন।
বন্যার কারণে এই সমস্যা শুধু বাশিক মিয়ার একার নয়, গরু, ছাগল, হাঁস ও মুরগি নিয়ে অসংখ্য লোক একই বিপদে পড়েছেন। অনেকে উঁচু এলাকায় স্বজনের বাড়িতে গরু-ছাগল পাঠিয়ে দিয়েছেন। যাঁদের সেই সুযোগ নেই, তাঁরা গৃহপালিত পশুপাখি নিয়েই আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গবাদিপশু আর মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে কোনোরকমে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেকের হাঁস-মুরগি আবার বানের পানিতে ভেসে গেছে।