ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটিতে অগ্নিদুর্ঘটনার চার দিন অতিবাহিত হতে চলেছে। কিন্তু এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি ওই দুর্ঘটনায় লঞ্চের নিখোঁজ যাত্রীর সংখ্যা। বরগুনা জেলা প্রশাসন, ঝালকাঠি পুলিশ প্রশাসন ও যুব রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকেরা যে তালিকা করেছেন, তাতে নিখোঁজদের সংখ্যার ব্যাপক অমিল রয়েছে। তাই এই দুর্ঘটনায় ঠিক কতজন নিখোঁজ আছেন, এ নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।
বরগুনা জেলা প্রশাসন যে তালিকা করেছে, তাতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকায় ৩৩ জনের নাম আছে। অপর দিকে ঝালকাঠি জেলা পুলিশ যে তালিকা করেছে তাতে নিখোঁজ আছেন ৪০ জন। এর মধ্যে ১৬ জন নারী, ৮ জন পুরুষ ও ১৫ জন নারী। আর ঝালকাঠি যুব রেড ক্রিসেন্ট যে তালিকা করেছে, তাতে নিখোঁজ আছেন ৫১ জন। ওই দিন দুর্ঘটনার সময় লঞ্চটিতে কত সংখ্যক যাত্রী ছিলেন এবং এরই মধ্যে কতজন প্রাণে বেঁচেছেন, তারও কোনো তথ্য মেলেনি। এ জন্য পুরো বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি আছে।
তবে ঝালকাঠি ও বরগুনার দুই জেলা প্রশাসক আজ সোমবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেছেন, জেলা প্রশাসনের করা তালিকাটিই নিখোঁজদের চূড়ান্ত তালিকা। এটা নিয়েই কাজ করছে প্রশাসন।
তবে যুব রেড ক্রিসেন্টের ঝালকাঠির স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বয়কারী রাজু আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পর থেকেই তাঁদের ৩৫ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। পৌর মিনিপার্কে বুথ খুলে তাঁরা নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছ থেকে যে তালিকা পেয়েছেন, তাতে নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা ৫১।
বরগুনা জেলা প্রশাসন যে তালিকা করেছে, তাতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকায় ৩৩ জনের নাম আছে। অপর দিকে ঝালকাঠি জেলা পুলিশ যে তালিকা করেছে তাতে নিখোঁজ আছেন ৪০ জন। আর ঝালকাঠি যুব রেড ক্রিসেন্ট যে তালিকা করেছে, তাতে নিখোঁজ আছেন ৫১ জন।
লঞ্চটির যাত্রী ছিলেন এমন প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। ওই দিন লঞ্চটি থেকে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মুহাম্মদ আল মুজাহিদ বেঁচে ফিরেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের সময় স্ত্রী উম্মুল ওয়ারাকে নিয়ে ওই লঞ্চের দ্বিতীয় তলার ভিআইপি কেবিনে ছিলাম। আগুনের ধোঁয়ার গন্ধে কেবিন থেকে বের হই। বের হতেই মানুষকে তাড়াহুড়া করতে দেখে দোতলার সামনের অংশে চলে যাই। এ সময় দোতলার রেলিং বেয়ে স্ত্রী উম্মুল ওয়ারা নিচতলার ফাঁকা অংশে ঝাঁপ দেন। তাঁকে দেখে আমিও দ্রুত দোতলা থেকে নিচতলায় ঝাঁপ দিই। ঝাঁপ দেওয়ার সময় আমার স্ত্রীর ডান পায়ের তলার অংশ মচকে গিয়ে ভেঙে যায়। এ সময় লঞ্চটি তীরের কাছাকাছি আসতেই দেড় শতাধিক যাত্রী লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়েন। এরপর শতাধিক যাত্রীদের লাফিয়ে নামতে দেখেছি। তবে ঢাকা থেকে অভিযান-১০ ছাড়ার সময় লঞ্চে সহস্রাধিক যাত্রী ছিলেন।
বেঁচে বাড়ি ফেরা লঞ্চটির আরেক যাত্রী বরগুনার ব্যবসায়ী সগির হোসেন বলেন, ঢাকা থেকে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় যখন লঞ্চটি ছেড়ে আসে, তখন তাঁর অনুমান ৭৫০-৮০০ যাত্রী ছিল। এরপর চাঁদপুর ঘাট থেকে আরও ২০০-২২৫ জন যাত্রী তোলা হয়। রাত ১টার দিকে বরিশাল নৌবন্দরে ভিড়লে সেখানে ১৫-২০ জন যাত্রী বরিশালে নেমে যান।
প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, এই দুর্ঘটনায় আজ পর্যন্ত ৩৯ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার পর বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দগ্ধ ও আহত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ১০১ জন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী নিখোঁজ আছেন ৩৩ জন। এতে সব মিলিয়ে হতাহত ১৭২ জন যাত্রীর হিসাব পাওয়া যায়। লঞ্চটিতে যদি এক হাজার যাত্রী থাকেন সেদিন, তাহলে বাকিরা বেঁচে বাড়ি ফিরেছেন।
কিন্তু এত যাত্রী বেঁচে বাড়ি ফিরলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সংখ্যা নিয়ে তিন ধরনের তথ্য আসছে কেন, এই প্রশ্নও উঠছে। বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের আলোচিত ও মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার বিষয়ে নিখোঁজ হওয়া যাত্রীদের ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি সূত্রের তথ্যের গরমিলের পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে একটি সমন্বয়হীনতা এবং অপরটি নিখোঁজের সংখ্যা হয়তো আরও বেশি। তিনি বলেন, ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, লঞ্চটিতে অন্তত এক হাজার যাত্রী ছিল। তদন্ত কমিটিও এমন তথ্যের মিল পেয়েছে বলে আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি। এটা সত্যি ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে।’
ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘বরগুনা জেলা প্রশাসন যে তালিকা দিয়েছে, সেটাকেই আমরা নিখোঁজদের অফিশিয়াল তালিকা মনে করছি। অন্যগুলো নয়।’ লঞ্চটিতে কত যাত্রী ছিলেন, কত যাত্রী প্রাণে রক্ষা পেয়ে দুর্ঘটনার পর বাড়ি ফিরেছেন এমন তথ্য পাওয়া গেছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এমন তথ্য নেই। এটা বিআইডব্লিউটিএর ঢাকার সদরঘাটের কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।’
সদরঘাট থেকে বন্দর ট্রাফিক পরিদর্শক যে পরিদর্শন প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, তাতে লঞ্চটি ওই বন্দর ত্যাগের সময় ৩১০ জন যাত্রী-নাবিক থাকার প্রত্যয়ন দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ডেকে ২২০ জন, কেবিনে ৫৫ জন, শিশু ১০ জন, নাবিক ১৫ জন, স্টাফ ১০ জন। তবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এর চেয়ে বেশি যাত্রী থাকার সত্যতা পেয়েছে।
বরগুনা জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা এখন নিখোঁজদের উদ্ধার, বেওয়ারিশ ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্ত করা এবং তদন্তকাজে সহযোগিতা করছি। লঞ্চটিতে কী সংখ্যক যাত্রী ওই দিন ছিলেন বা কতজন অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরেছিলেন, সে তথ্য আমাদের কাছে নেই।’