নারী বেশে দর্শকের মন মাতান তাঁরা

অভিনয়ের ফাঁকে সাজ নিচ্ছেন নারীবেশী পুরুষ শিল্পীরা। বৃহস্পতিবার ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কাশিডাঙ্গা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
অভিনয়ের ফাঁকে সাজ নিচ্ছেন নারীবেশী পুরুষ শিল্পীরা। বৃহস্পতিবার ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কাশিডাঙ্গা গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো

পরনে রঙিন শাড়ি, খোঁপায় ফুলের মালা আর ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক মেখে নারীর বেশে অভিনয় করছেন পুরুষ। রঙ্গ–রসিকতার মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে ঘটমান জীবনের নানা ঘটনা। এ দৃশ্য ধামের গানের। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এখন চলছে ঐতিহ্যবাহী এ লোকনাট্য।

‘ধাম’ শব্দের অর্থ স্থান বা আশ্রয়স্থল। এর মাধ্যমে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য সমবেত হওয়ার জায়গাকে বোঝায়। এমন স্থানে কথোপকথন ও গানের মাধ্যমে উপস্থাপিত লোকজ নাট্যকে ধামের গান বলা হয়। এটি বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলের ঐতিহ্য।

জানতে চাইলে প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও নাট্যব্যক্তিত্ব মনতোষ কুমার দে বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ে লোকনাট্য ধামের গান সারিগান বা সোরিগান হিসেবেও পরিচিত। এ লোকনাট্যে কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। তবু ধামের গান চর্চায় মানুষের উৎসাহের ঘাটতি নেই।

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কোজাগরী পূর্ণিমা, অর্থাৎ লক্ষ্মীপূজার পরের তিথি থেকে ধামের গান করেন। চলে শ্যামাপূজা পর্যন্ত। ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকায় সোমবার থেকে এ গান শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সদর উপজেলার চাটাই পুকুর, বলদিয়া পুকুর, আকচা, ফাঁড়াবাড়ি, বড় ধাম ও কাশিডাঙ্গা।

ধামের গানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ধামের গানে পুরুষেরাই নারীর চরিত্রে অভিনয় করেন। সাধারণত স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সাধারণ ঘটনা রঙ্গরস ও হালকাভাবে ধামের গানে তুলে ধরা হয়। মঞ্চ বা আসরের মধ্যবর্তী জায়গায় শিল্পী ও কলাকুশলীরা বৃত্তাকারে বসে থাকেন। সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বৃত্তাকার অংশের চারদিকে ফাঁকা জায়গায় ঘুরে ঘুরে অভিনয় ও গীত পরিবেশন করেন তাঁরা।

গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কাশিডাঙ্গা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বটগাছের তলায় বসেছে ধামের গানের আসর। এতে লক্ষ্মীরহাট গ্রামের একটি দলের পরিবেশনায় সাইকেলশরী-হ্যান্ডেল বাউদিয়া নামের পালা চলছে। এ পালায় চারটি নারী চরিত্র রয়েছে। এসব চরিত্রে লম্বা পরচুলা, নাকফুল ও দুল পরে অভিনয় করছেন ধনি চন্দ্র রায়, বিজয় রায়, নরেশ রায় ও কেশব বর্মণ। অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা আয়না দেখে ঠোঁটে লিপিস্টিক ও গালে পাউডার লাগানোর পাশাপাশি গুছিয়ে নিচ্ছেন পরনের শাড়ি।

ওই দলের পরিচালক সুশেন রায় বলেন, গ্রামে নারী অভিনেত্রী থাকলেও ঐতিহ্যগতভাবে ধামের গানে পুরুষই নারীর চরিত্রে অভিনয় করেন। ধামের গানের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে এ রীতি এখনো মেনে চলা হচ্ছে।

অভিনয়ের ফাঁকে নরেশ রায় বললেন, ‘যখন শাড়ি পরে, খোঁপা বেঁধে, লিপিস্টিক লাগিয়ে অভিনয় করি, তখন অনেকেই আমাকে মেয়ে ভেবে বসে। এমনটা হলে বুঝি অভিনয় ভালো হচ্ছে।’