শখের বসে বাড়ির দোতলার বারান্দায় পাঁচটি ক্যাকটাস ও দুটি বনসাই কিনে এনে পরিচর্চা শুরু করেন এক চিকিৎসক দম্পতি। সেগুলোর পরিচর্চা করতে গিয়ে তাঁরা বনসাইয়ের প্রেমে পড়ে যান। পরে বাড়ির ছাদে ধীরে ধীরে বনসাই ‘রাজ্য’ গড়ে তোলেন তাঁরা।
ওই ছাদে ফুল-ফল-ঔষধি, বনসাইসহ দেশি-বিদেশি দেড় শতাধিক প্রজাতির দেড় হাজার গাছ রয়েছে। বাড়ির ছাদ পুরোটাই ঢেকে গেছে সবুজে।
দন্ত চিকিৎসক (ডেন্টাল সার্জন) মাহফুজা আক্তার ও এমবিবিএস চিকিৎসক (শিশু মেডিসিন) ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী দম্পতি তাঁদের পাঁচতলা বাড়ির ১ হাজার ২০০ বর্গফুট ছাদে এই বাগান গড়ে তুলেছেন।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় নিমাইকাসারী এলাকার ১৭০ হোল্ডিংয়ের চিকিৎসক দম্পতির বাড়ির ছাদে গিয়ে দেখা মেলে সবুজের সমারোহ। পুরো ছাদবাগানে বনসাই ও প্রি-বনসাই গাছে ছেয়ে গেছে।
মাহফুজা গাছের প্রতি ভালোবাসা থেকে ২০১৫ সালের আগস্টে বনসাই বাগান করার উদ্যোগ নেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন স্বামী ফয়েজ। শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবুল বাশার তাঁকে পরামর্শ ও উৎসাহ দেন। শুরুতে ছাদের টবে মাটিতে গাছ লাগাতেন। পরে টবে মাটির পরিবর্তে নারিকেলের ছোবার ডাস্ট ও ইটের গুঁড়া ব্যবহার শুরু করেন। এতে পানি জমে গাছের গোড়া পচার ভয় থাকে না। তাঁদের বাগানে দেশি-বিদেশি পাঁচ শতাধিক বনসাই রয়েছে। এ ছাড়া প্রি-বনসাই আছে এক হাজারের অধিক। যেগুলো আগামী এক বছরের মধ্যে বনসাইয়ে পরিণত হবে।
চিকিৎসক দম্পতির বাগানে ২০ প্রজাতির বটগাছ, বিদেশি এডেনিয়াম প্রায় ৪০ রঙের। দেশি বিলুপ্ত প্রজাতির ছাতিম, হিজল, তমাল, অশোক, দুর্লভ নাগলিঙ্গম, আফ্রিকান বাউবব রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাইন, জাকারান্ডা, ব্রাশচেরি, ফুকেনটি, পুডুকার্পাস ইত্যাদি।
দেশীয় আম, জাম, তেঁতুল, নারকেলসহ বিভিন্ন ফলের গাছ রয়েছে। ফুলের মধ্যে বাগানবিলাস, রঙ্গন, জুঁই, ক্যামেলিয়া, জবা ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস, সাকুলেন্ট, ইউফোরবিয়া, অর্কিড, পাম, বাঁশসহ ঔষধি গাছ রয়েছে।
ওই দম্পতি জানান, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়, গাছ ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকে তাঁরা ওই বাগান গড়ে তোলেন। তাঁদের বনসাই বাগান দেখতে দূরদূরান্ত থেকে অনেক লোকজন আসেন। বনসাই করার পদ্ধতিসহ নানা বিষয়ে তাঁদের কাছ থেকে জেনে নেন অনেকেই।
গাছ সংগ্রহ করা প্রসঙ্গে মাহফুজা বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁরা বনসাই গাছ সংগ্রহ করেছেন। নার্সারিতে অর্ডার দিয়ে ভারত থেকে কিছু গাছ সংগ্রহ করেছেন।
মাহফুজা আরও বলেন, ভবন নির্মাণের সময় অনেক গাছ কাটা পড়ে। তাঁরা সেসব গাছ সংগ্রহ করে বনসাই করেন। যেখানেই বিলুপ্ত ও বিরল প্রজাতির গাছের সন্ধান পেয়েছেন, সেখানেই ছুটে গেছেন তাঁরা। নিজের সন্তানকে যেভাবে লালন-পালন করেন, ঠিক সেভাবেই বনসাইগুলোর যত্ন নেন বলে জানান তিনি।
ফয়েজ আহমেদ বলেন, তাঁদের চার মেয়েই ফল খাওয়ার সময় জানতে চাইত, বাবা ওই ফল গাছ দেখতে কেমন! কিন্তু এখন তো আগের মতো গাছ নেই, তাঁদের দেখাব। তাই গাছ চেনার জন্য বিলুপ্ত প্রজাতিসহ বিভিন্ন গাছ বনসাই করার উদ্যোগ নেন তাঁরা। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গাছ চিনতে ও জানতে পারে।
ফয়েজ আহমেদ আরও বলেন, বনসাই করতে হলে প্রচুর ধৈর্য ও সময়ের প্রয়োজন হয়। বড় প্রজাতির গাছকে ছোট আকৃতি আনতে অন্তত দুই থেকে পাঁচ বছর সময় লেগে যায়। গাছের ডালপালা কেটে রাখা, পরিবর্তন, সেপিং এবং প্রচুর জৈব সার ব্যবহার করতে হয়। ফাঙ্গাল দেখা দিলে ওষুধ ব্যবহার করতে হয়।
মাহফুজার শ্বশুর সাবেক কৃষি কর্মকর্তা আবুল বাশার বলেন, গাছের প্রতি ছেলের বউয়ের ভালোবাসায় মুগ্ধ তিনি। পেশাজীবী হয়েও নিজ হাতে পরিচর্চা করে বাগান গড়ে তুলেছেন।
শিমরাইল ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, গাছগুলোতে ছত্রাকের আক্রমণসহ বিভিন্ন বিষয়ে কৃষি বিভাগ থেকে তাঁদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ওই বাগান দেখলে ক্যাকটাস, বনসাইয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মাবে। এটা আমাদের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।’
ইউএনও নাহিদা বারিক প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসক দম্পতির গাছের প্রতি ভালোবাসা ও বাড়ি ছাদে বনসাই বাগান পুরো সদরে দৃষ্টান্ত। অবসরে বাগান করা প্রকৃতির সঙ্গে এক ধরনের প্রেম। ছাদবাগানকে উৎসাহিত করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।