নেত্রকোনার মদন

নামেই পৌরসভা, মিলছে না নাগরিক সেবা

নেত্রকোনার মদন পৌর ভবনটি বেহাল। গত সোমবার তোলা
প্রথম আলো

তিনতলা ভবনের সামনে ছোট সড়ক। তারপর মগড়া নদী। প্রাঙ্গণে স্তূপ করে রাখা ব্যবসায়ীদের ইট, সুরকি ও বালু। তাতে কয়েকটি ছাগল ও কুকুর খেলা করছে। ভবনের ডান পাশ ও পেছনে জলাশয়। বাঁ পাশে বিস্তীর্ণ কৃষিজমি। ভবনের আঙিনায় চড়ছে মুরগি। নিচতলার কক্ষগুলোতে আবর্জনার স্তূপ। নেই সেবাগ্রহীতা বা কর্মকর্তাদের ভিড়।

এ হচ্ছে নেত্রকোনার মদন পৌরসভার ভবন। জাহাঙ্গীরপুর এলাকায় এই ‘খ’ শ্রেণির পৌর ভবনের অবস্থান। গত ১০ ডিসেম্বর সেখানে গিয়ে দেখা যায় এ চিত্র।
মদন পৌরসভার বয়স ২০ বছর। পৌর ভবন যেন পৌর শহরের প্রতীক। পৌরবাসীর জীবনে তেমন কোনো ছোঁয়া লাগেনি শহুরে জীবনের। চারদিকে গ্রামীণ আবহ। পাওয়া যাচ্ছে না নাগরিক সেবা। বেশির ভাগ রাস্তাঘাট কাঁচা। বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আর্সেনিকের ঝুঁকি থাকলেও নলকূপের পানিই ভরসা। সড়ক বাতিও গুটিকয়। নালা ব্যবস্থাপনা একেবারেই অপ্রতুল। পৌরবাসীর অভিযোগ, এটি কেবল নামেই পৌরসভা। নিয়মিত কর দিয়ে ন্যূনতম সেবা মেলে না।

পৌরসভার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালের ১ অক্টোবর এই পৌরসভার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। ২০০২ সালের ২৬ অক্টোবর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালের ৩১ জুলাইয়ে ‘গ’ শ্রেণির পৌরসভা থেকে ‘খ’ শ্রেণিতে উন্নীত হয়। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পৌর এলাকার জনসংখ্যা ১৭ হাজার ৩৮৮ জন। তবে বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। আয়তন ১০ দশমিক ১১ বর্গকিলোমিটার।

অবশ্য পৌরসভা আইনের (২০০৯) শর্ত মানতে হলে মদনকে পৌরসভা বা শহর বলা একটু কঠিন। ওই আইনে আছে, পৌর এলাকার জনসংখ্যা ৫০ হাজারের কম হবে না, জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে দেড় হাজারের কম নয়। ৩৩ শতাংশ ভূমি অকৃষি প্রকৃতির, তিন-চতুর্থাংশ ব্যক্তি অকৃষি পেশায় নিয়োজিত থাকতে হবে।
পৌরসভার সচিব জাহাঙ্গীর আলম ও কর আদায়কারী আবদুস সালাম জানান, এখানকার অর্ধেকের বেশি মানুষ কৃষিনির্ভরশীল। মোট ভূমির অর্ধেকের বেশি কৃষিজমি।

পৌর এলাকার জাহাঙ্গীরপুর, দেওয়ানবাজার, মদন সেন্টারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, রাস্তাঘাট, দোকান—সর্বত্রই ময়লা পড়ে আছে। পৌরসভার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলার কোনো ব্যবস্থা নেই। বর্জ্য সরবরাহের জন্য একটি ট্রাক থাকলেও তা কাজে আসে না। জাহাঙ্গীরপুর থেকে মদনবাজার পর্যন্ত প্রধান সড়কে প্রায় তিন কিলোমিটার জায়গায় সড়কবাতি থাকলেও অন্য কোনো রাস্তায় নেই। অধিকাংশ রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা। নালা ব্যবস্থাপনা একেবারেই নাজুক।

পৌরসভা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখানে আরসিসি নালা মাত্র এক কিলোমিটার ও ইটের তৈরি নালা আছে চার কিলোমিটার। মোট সড়ক ৫৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে ২৪ কিলোমিটার পাকা সড়ক। বাকি সড়ক এখনো কাঁচা। পাকা বাড়িও অল্পসংখ্যক, ১৭০টি। পৌরসভায় সব মিলিয়ে জনবল মাত্র ১৪ জন। অথচ ‘খ’ শ্রেণির পৌরসভার জনবল ৯৬ জন থাকার কথা।

সরেজমিনে দেখা যায়, মদন প্রেসক্লাব ও উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের পাশে ময়লার স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। মধ্যবাজার এলাকায় প্রধান সড়কের পাশে খাদ্যগুদামের সামনের জায়গাজুড়ে ময়লা-আবর্জনা জমে আছে। স্থানীয় লোকজন বলেন, বর্ষা মৌসুমে পানিনিষ্কাশন না হওয়ায় এখানে কাদা–পানি একাকার হয়ে যায়।

স্থানীয় মুনসুর মিয়া বলেন, মদনে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। শুধু খাজনাটা বেশি দিতে হয়। কিন্তু কোনো সেবা পাওয়া যায় না। ভোটের সময় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা উন্নয়নের জোয়ার আনার প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু কখনো তা বাস্তবায়িত হয় না।

মদনের বৈশ্যপাড়ার একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি বলেন, ‘পৌরসভায় সরকারি বরাদ্দ তো আর কম আসে না। শুনেছি নগর উন্নয়ন প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে। এ ছাড়া আমরা ট্যাক্স দিই। কিন্তু কোনো সেবা পাই না। সেবা নিতে কেউ পৌরসভায় যান না। শুধু ট্যাক্স দিতে যান।’

পৌর মেয়র আবদুল হান্নান তালুকদার বলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে অনেক কাজ করেছেন। তবে পৌরবাসীকে সব পৌরসেবা দেওয়া যাচ্ছে না। বর্জ্য, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট আরও উন্নত করতে হবে। পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাঁরা সরকারি অনুদান কম পান। গত বছর প্রায় ১১ লাখ টাকার কর আদায় হয়। এর বাইরে ট্রেড লাইসেন্স, হাটবাজার ইজারা ও অন্য ফরম বিক্রি থেকে সামান্য কিছু আয় হয়।