গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ১ বছরে ২ হাজার ২৫৩টি ধর্মীয় সভার নামে ৫ হাজার ৮২৩ মেট্রিক টন চাল আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এই পরিমাণ চালের বর্তমান বাজারদর ২২ কোটি ৩ লাখ ২১ হাজার ৫৯০ টাকা।
এ ঘটনায় গত ২৬ আগস্ট মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে আওয়ামী লীগের বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও তৎকালীন মহিমাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ প্রধানসহ ১৯ জনকে আসামি করা হয়।
দুদক রংপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. হোসাইন শরীফ বাদী হয়ে তাঁর কার্যালয়ে মামলাটি করেন। হোসাইন শরীফ বলেন, প্রাথমিক তদন্তে আত্মসাতের সত্যতা মিলেছে। ইতিমধ্যে ঘটনার সময়ের কিছু কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন গোবিন্দগঞ্জের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) জহিরুল ইসলাম, উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান (তৎকালীন) আকতারা বেগম, কামদিয়া ইউপির চেয়ারম্যান মোশাহেদ হোসেন চৌধুরী, কাটাবাড়ির রেজাউল করিম, শাখাহারের তাহাজুল ইসলাম, রাজাহারের আবদুল লতিফ সরকার, সাপমারার শাকিল আহম্মেদ, দরবস্তের শরিফুল ইসলাম, তালুককানুপুরের আতিকুর রহমান, নাকাইয়ের আবদুল কাদের প্রধান, রাখালবুরুজের শাহাদত হোসেন, ফুলবাড়ীর আবদুল মান্নান মোল্লা, গুমানীগঞ্জের শরীফ মোস্তফা জগলুল রশিদ, কামারদহের (তৎকালীন) শরিফুল ইসলাম, কোচাশহরের মোশাররফ হোসেন, শিবপুরের সেকেন্দার আলী মণ্ডল, শালমারার (তৎকালীন) আমির হোসেন ও গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর (তৎকালীন) গোলাপী বেগম।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উপজেলায় আসামিরা ২ হাজার ২৫৩টি ধর্মীয় সভা দেখিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নসংক্রান্ত জাল কাগজপত্র তৈরি করেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠনসংক্রান্ত কাগজপত্রে সব সদস্যের সই একই রকমের এবং হাতের লেখাও এক।
বিবরণে বলা হয়, তৎকালীন পিআইও ২ হাজার ২৫৩ জন প্রকল্প সভাপতির অনুকূলে ৫ হাজার ৮২৩ মেট্রিক টন চাল সরবরাহে ডিও (আধা সরকারি পত্র) ইস্যু করেন। পরে সংশ্লিষ্ট ইউপির চেয়ারম্যান, উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরসভার মহিলা কাউন্সিলররা নিজ নিজ ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডে ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন হয়েছে মর্মে প্রত্যয়ন দেন।
কাটাবাড়ি ইউপির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না। প্রত্যয়নও দেননি।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, উপজেলার গোলাপবাগ, কামদিয়া ও মহিমাগঞ্জ খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা চাল সরবরাহকালে বিলি আদেশের তৃতীয় কপিতে প্রকল্প সভাপতিদের ভুয়া সই গ্রহণ করে চাল সরবরাহ দেন। বিলি আদেশের তৃতীয় কপিতে প্রকল্প সভাপতিদের যেসব সই রয়েছে, তা একই রকমের।
জেলা ত্রাণ কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ধর্মীয় সভায় আসা ব্যক্তিদের খাবার বাবদ ৫ হাজার ৮২৩ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়। ২০১৭ সালের জুনে অধিদপ্তর থেকে ২ হাজার ২৫৩টি প্রকল্পের অনুকূলে এই বরাদ্দ দেওয়া হয়।
তালুককানুপুর ইউপির চেয়ারম্যান আতিকুর রহমানের অভিযোগ, সে সময় আবদুল লতিফ প্রধান ছিলেন উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সমিতির সভাপতি। বর্তমানে তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সে সময় তিনিসহ তিনজন ইউপি চেয়ারম্যান সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। অন্য দুজন হলেন দরবস্ত ইউনিয়নের শরিফুল ইসলাম এবং গুমানীগঞ্জের শরীফ মোস্তফা জগলুল রশিদ। তাঁদের নেতৃত্বে সই জাল ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা হয়। এ জন্য তিনি (আতিকুর) প্রত্যয়ন দেননি।
উপজেলা খাদ্য বিভাগের সূত্র জানায়, চেয়ারম্যানরা ২০১৭ সালের জুনের শেষে মাত্র কয়েক দিনে ৫ হাজার ৮২৩ মেট্রিক টন চাল উত্তোলন করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চাল ব্যবসায়ী জানান, একটি ট্রাকে ২০ মেট্রিক টন বহন করা হলেও এই পরিমাণ চাল বহনে ১৯০টি ট্রাক দরকার। এতগুলো ট্রাক লোড-আনলোড করতে কেউ দেখেনি।
মামলার বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা হোসাইন শরীফ বলেন, এই ঘটনায় আরও কেউ জড়িত কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
গোবিন্দগঞ্জ নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মতিন মোল্লা বলেন, এক অর্থবছরে এতগুলো ধর্মীয় সভা হওয়া অবিশ্বাস্য। ওই অর্থবছরে উপজেলায় ১৫০-২০০টির বেশি ধর্মীয় সভা হওয়ার কথা নয়।
পিআইও জহিরুল ইসলাম বলেন, সাধারণত অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের নামেই সরাসরি এসব বরাদ্দ আসে। প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠানপ্রধানেরা আবেদন করলে ডিও দেওয়া হয়।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ প্রধান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তৎকালীন গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের সাংসদ আবুল কালাম আজাদের ডিও লেটারে এই বরাদ্দ আসে। সে সময় তাঁর কিছু লোক মালামাল তুলে নিয়ে গেছেন। কিছু মালামাল প্রকল্প সভাপতিরা পেয়েছেন। ওই সময় কাজ হয়েছে মর্মে সাবেক সাংসদ প্রত্যয়ন দিয়েছিলেন।
সাবেক সাংসদ আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ওই সময় ধর্মীয় সভায় বরাদ্দের জন্য তিনি কোনো ডিও লেটার দেননি।