রাতে মাথার ওপর চকচকে আলো জ্বলত। মানুষের কোলাহলপূর্ণ থাকত এলাকা। লোহার ঘণ্টা আর গার্ডের হুইসেল বাজত নিয়মিত। গাড়ি থেকে মাল ওঠানো-নামানোয় ব্যস্ত থাকতেন কুলি সর্দারেরা। এসবই আজ ইতিহাস। এখন আর আগের মতো কিছুই হয় না। অযত্ন-অবহেলায় জরাজীর্ণ হয়ে আছে। এটি কুষ্টিয়ার জগতি রেলস্টেশন। বাংলাদেশের প্রথম রেলস্টেশন।
রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে—১৮৬২ সালে। প্রথম দিকে শুধু অর্থনৈতিক কাজের জন্য রেলপথ চালু করা হয়। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নামের একটি প্রতিষ্ঠান প্রথম এ অঞ্চলে রেলপথ স্থাপন করে। প্রতিষ্ঠানটি ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে রানাঘাট এবং ওই বছরের ১৫ নভেম্বর রানাঘাট থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ চালু করে।
জরাজীর্ণ এই রেলস্টেশন এখন শুধুই ইতিহাস। আজ ১৫ নভেম্বর এই রেলস্টেশনের বয়স ১৫৫ বছর হলো।
সরেজমিন দেখা যায়, লাল ইটের খাঁড়া এক দালান দাঁড়িয়ে আছে। ইটের রং ফিকে গেছে। ফাটল ধরেছে তার গায়ে। আশপাশে ও ছাদ ঘাস আর ছোট ছোট আগাছায় ভরে গেছে। ঘরের ভেতরে সেই আমলের কিছু আসবাবপত্র জরাজীর্ণভাবে পড়ে আছে। রয়েছে বেশ কয়েকটি অকেজো টেলিফোন। রাতের বেলায় ট্রেনের সংকেত নেওয়ার লোহার বাতিগুলোয় ধুলোর আস্তর পড়ে গেছে। এসব আর ব্যবহার করা হয় না।
বর্তমানে এই রেলস্টেশন তিনজন কর্মচারী দেখাশোনা করেন। তাঁদের একজন আবদুস সালাম। তিনি বলেন, কালের বিবর্তনে দেশের অনেক রেলস্টেশনের অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু দেশের প্রথম রেলস্টেশন জগতির কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতো ট্রেনও এখানে থামে না। বিদ্যুৎ নেই, বাতি নেই। সন্ধ্যার পরপরই ভুতুড়ে পরিবেশ হয়ে যায়।
জগতি গ্রামের বৃদ্ধ জিয়া উদ্দীন বলেন, স্টেশনে ফুলের বাগান ছিল। ছিল স্টাফ কোয়ার্টার। সব সময় ১৩ থেকে ১৪ জন কর্মকর্তা কর্মচারী থাকতেন। একসময় এই স্টেশনে প্রচুর মাল ওঠানো-নামানো হতো। পান থেকে শুরু করে ধান, সার—সব মালামাল ট্রেনে করে আসত।
স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশের চেচুয়া গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ আজগর আলী। তিনি জানালেন, রেলস্টেশনের পাশেই দুটি সুউচ্চ পানির টাওয়ার ট্যাংক রয়েছে। তৎকালীন সময়ে কয়লার ইঞ্জিনে পানি দেওয়া হতো। এগুলোও নষ্ট হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। দুই থেকে পাঁচ পয়সা ভাড়া দিয়ে ট্রেনে চলাচল করতেন তিনি।
স্টেশনের পাশে চায়ের দোকানদার ফরজ আলী বলেন, এই স্টেশনের অনেক সম্পদ আছে, যা হারিয়ে যাচ্ছে। এ স্টেশনের ইতিহাস ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।