কক্সবাজার শহর থেকে সমুদ্রপথে উত্তর দিকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার গেলে মহেশখালীর দ্বীপ ইউনিয়ন মাতারবাড়ী। দ্রুতগতির স্পিডবোটে যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টা। ইউনিয়নের ৮০ হাজার জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের পেশা ছিল সমুদ্রে মাছ আহরণ এবং কয়েক হাজার একরের খোলা মাঠে লোনাপানি জমিয়ে লবণ উৎপাদন করা। এখন দুর্গম এই উপকূলের ১ হাজার ৬০০ একরের লবণমাঠে গড়ে উঠছে দেশের বৃহৎ সমন্বিত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ১০টি মেগা প্রকল্পের একটি।
প্রকল্পের উত্তর পাশে কুতুবদিয়া চ্যানেল, পশ্চিম ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, আর পূর্ব পাশে কুহেলিয়া নদী। মধ্যভাগের জমিতে দিন-রাত সমানে চলছে দেশি-বিদেশি প্রায় সাত হাজার প্রকৌশলী-শ্রমিকের মহাকর্মযজ্ঞ। স্থানীয় বাসিন্দাদের আশা, আড়াই বছর পর এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে আলোকিত হবে পুরো কক্সবাজার জেলা। তখন পাল্টে যাবে মাতারবাড়ী-মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার অর্থনৈতিক চিত্র। দূর হবে বেকার সমস্যা।
১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার এই তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ হচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা দিচ্ছে ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকারের। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড।
কোল পাওয়ারের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, করোনা মহামারির মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রকল্পের কাজ চলমান রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎ সংরক্ষণ-সরবরাহের যন্ত্রপাতি স্থাপনসহ প্রকল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এ পর্যন্ত ৫৬ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ফলে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। তখন এলাকার চেহারা পাল্টে যাবে।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে রওনা দিই মাতারবাড়ীর রাজঘাট থেকে। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে নির্মাণাধীন তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় প্রকল্পের উত্তর পশ্চিমে ২ নম্বর গেটে পৌঁছে দেখি একটি তল্লাশিচৌকি। কোল পাওয়ারের অনুমতি ছাড়া বাইরের কারও প্রকল্পে প্রবেশ নিষিদ্ধ। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর নিরাপত্তাকর্মীরা ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেন।
প্রকল্প এলাকার ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল মহাকর্মযজ্ঞ। দক্ষিণ-পশ্চিমে চার কিলোমিটারের একটি সড়কপথ। পশ্চিমে সড়কের শেষ প্রান্তে ১৪ কিলোমিটারের মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর চ্যানেল। কোল পাওয়ারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, চ্যানেলের প্রস্থ ২৫০ মিটার, গভীরতা ১৮ মিটার। বঙ্গোপসাগর থেকে এই চ্যানেলে ঢুকে বিদেশি জাহাজগুলো পণ্য খালাস করে। চ্যানেলের সঙ্গে তৈরি হয়েছে পণ্য খালাসের একটি জেটি। জেটিতে ভেড়ানো আছে ভিয়েতনাম থেকে আসা মালবাহী একটি জাহাজ। জাহাজ থেকে ক্রেনের মাধ্যমে নামানো হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্টিল সরঞ্জাম।
চ্যানেলের উত্তর-পশ্চিমে লম্বা পাথরের বাঁধ। দুই হাজার মিটারের বেশি দীর্ঘ এই বাঁধ দেওয়ার কারণ, সমুদ্রের বালুতে যেন চ্যানেলটি ভরাট না হয়। দক্ষিণ পাশে তৈরি হচ্ছে আরও একটি জেটি। সেখানে কাজ করছেন দুই শতাধিক শ্রমিক।
কর্তৃপক্ষ জানায়, জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সুমিতমো করপোরেশন, তোশিবা করপোরেশন ও আইএসআইয়ের তত্ত্বাবধানে নির্মাণকাজে নিয়োজিত আছেন ১৭ দেশের ৫৫৪ জন বিদেশি নাগরিক। তাঁদের নির্দেশনায় কাজ করছেন বাংলাদেশি আরও সাড়ে ৬ হাজারের মতো শ্রমিক।
প্রকল্পের শ্রমিক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, রাতে ও দিনে দুই পালায় তাঁদের কাজ করতে হয়। প্রথম শিফটের কাজ শুরু হয় সকাল ছয়টায়, শেষ হয় সন্ধ্যা ছয়টায়। ১২ ঘণ্টার মধ্যে দুই ঘণ্টা বিরতি পান তাঁরা। ৮ ঘণ্টার কর্মঘণ্টার বাইরে ওভারটাইম পারিশ্রমিক পান তাঁরা। তিনিসহ কর্মরত শ্রমিকেরা বলেন, থাকা-খাওয়া সবই প্রকল্প এলাকায়। বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই, কারণ করোনাঝুঁকি।
প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, করোনায় এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন দেশি-বিদেশি মিলে ৪০৫ জন। কেন্দ্রের ভেতরে রয়েছে ২৫০ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি আইসোলেশন সেন্টার। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেখানে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যসেবার জন্য আছেন পাঁচজন চিকিৎসক ও সাতজন স্বাস্থ্যকর্মী। সংকট দেখা দিলে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় চট্টগ্রাম নগরে।
প্রকল্পের ভেতরে তৈরি করা হয়েছে চারতলাবিশিষ্ট দুটি ভবন। রয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অফিস, প্রকল্পে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের থাকার পৃথক ডরমিটরি, পুলিশ, আনসার সদস্যদের থাকার ব্যারাক। বিদেশিদের থাকার জন্য মাঠের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে তৈরি হচ্ছে আরও একাধিক বহুতল ভবন। তৈরি হয়েছে রেস্টহাউস, হেলিপ্যাড, উন্নত মানের রেস্তোরাঁ প্রভৃতি।
কোল পাওয়ারের নির্বাহী পরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২০২৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজের পণ্যসামগ্রী খালাসের জন্য তৈরি হয়েছে ১৮০ মিটার দীর্ঘ একটি স্থায়ী জেটি। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর সেই জেটিতে ভিড়েছিল প্রথম বিদেশি জাহাজ ‘ভেনাস ট্রাইয়াম্ফ’। এর মাধ্যমে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্দর চ্যানেলটি ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রতি মাসে প্রকল্পের বিভিন্ন মালামাল নিয়ে তিন থেকে চারটি জাহাজ চ্যানেলে ভিড়ছে।
কোল পাওয়ার সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হবে ৬০০ মেগাওয়াট। একই বছরের জুলাইয়ে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে উৎপাদিত হবে আরও ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখন দিনরাত প্রায় দেশি-বিদেশিদের সমন্বয়ে কাজ চলছে। এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল কাদের গণী প্রথম আলোকে বলেন, মাতারবাড়ী থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য চকরিয়া হয়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারী পর্যন্ত ১৫০ কিলোমিটারের ৪০০ কিলোভোল্ট (কেভি) ধারণক্ষমতার গ্রিড সঞ্চালন লাইন টানা হচ্ছে। ইতিমধ্যে মহেশখালী অংশে পাঁচ-ছয় কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে।
কোল পাওয়ারের নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘গত বছরের ২০ মার্চ থেকে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপ চললেও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে এই প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রাখা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে কাজ দ্রুত শেষ করে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতেই প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন করা।’ আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের বিপরীতে মাতারবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত ৪৫ পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়েছে। প্রকল্পের টাউনশিপ এরিয়ায় নির্মিত হবে মসজিদ, স্কুল-কলেজ, বিপণিকেন্দ্র, কমিউনিটি সেন্টার ইত্যাদি। এর ফলে স্থানীয় লোকজনের জীবনমানেরও উন্নতি ঘটবে।
তবে মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ উল্লাহ একটি সমস্যার কথা জানালেন। তিনি বলেন, প্রকল্পের জন্য এই এলাকার মানুষ জায়গা দিয়েছে। এ নিয়ে কোনো আন্দোলন কিংবা প্রতিবাদও হয়নি। কিন্তু প্রকল্পের জন্য আলাদা কোনো সড়ক নির্মাণ করা হয়নি। মাতারবাড়ীর জনগণের চলাচলের সড়কের ওপর দিয়ে প্রকল্পের ভারী যানবাহন চলাচল করছে। এ কারণে সড়কটির এখন বেশ নাজুক দশা।
এ বিষয়ে কোল পাওয়ারের নির্বাহী পরিচালক বলেন, মাতারবাড়ী ইউনিয়নের দক্ষিণ রাজঘাট থেকে প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটারের সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। কুহেলিয়া নদীর পশ্চিম পাশ দিয়ে সড়কটি ধলঘাট ইউনিয়নের মুহুরিঘোনায় গিয়ে শেষ হবে। চকরিয়া থেকে এই প্রকল্পে চার লেনের একটি সড়ক আসছে। যোগ হবে রেললাইনও। তখন আর স্থানীয় সড়কটি ব্যবহার করতে হবে না। আর তাতে পাল্টেও যাবে মাতারবাড়ীর চেহারা।
এই মেগা প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখতে সকাল-বিকেল লোকজন আসছে বিভিন্ন স্থান থেকে। তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকার সৈকতে তাঁরা ঘুরছেন। বেড়িবাঁধের ওপর বসে মুঠোফোনে কেউ ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন। কেউ কেউ মুঠোফোনে ধারণ করছেন সমুদ্রে অস্তগামী লাল সূর্যের ছবি। ঘুরতে আসা লোকজনের মধ্যে মাতারবাড়ীর স্থানীয় লোকজন ছাড়াও চকরিয়া, কক্সবাজারের লোকজন রয়েছেন।
সুদূর কক্সবাজার শহর থেকে প্রকল্প দেখতে আসা কয়েকজনের মধ্যে একজন নজরুল ইসলাম। তিনি এ প্রকল্প এলাকায় আসতে যাতায়াত ভোগান্তির কথা বললেন। কক্সবাজার শহর থেকে নৌপথে কিংবা সড়কপথে প্রকল্প এলাকায় আসার যাত্রীবাহী লঞ্চ কিংবা যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, যাতায়াত সহজ হলে প্রতিদিন এখানে হাজারো মানুষের ভিড় হতো।
চকরিয়া পৌর শহর থেকে আসা মোহাম্মদ তাসফিক বলেন, ‘বিদ্যুৎ প্রকল্প ঘুরতে এসেছিলাম, কিন্তু ভেতরে ঢোকার অনুমতি মেলেনি। যেভাবে কর্মযজ্ঞ চলছে, মনে হচ্ছে অচিরেই মাতারবাড়ী সিঙ্গাপুরের মতো হয়ে উঠবে।’
মাতারবাড়ীর সাইরার ডেইল এলাকার বাসিন্দা ফজলুল করিম বলেন, প্রতিদিন প্রকল্প দেখার জন্য বিপুল মানুষের সমাগম ঘটছে। প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হলে মাতারবাড়ীতে পর্যটনের নতুন দিগন্ত সূচিত হবে।