>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে করোনাভাইরাস আমাকে সোজা পাঠিয়ে দিয়েছে গ্রামের বাড়িতে। আসার সময় দু–চারটা চাকরির পরীক্ষার বই এনেছি। সারা দিনে দু–চার পৃষ্ঠামাত্র উল্টিয়ে পড়া হয়। এই দমবন্ধ সময়ে এসব আপাতত দূরে সরিয়ে রেখেছি।
বেশ কিছু বই সংগ্রহ করেছি পড়ার জন্য। কিউবা আমার অসীম আগ্রহের দেশ। আশা করি শাহাদুজ্জামানের আধোঘুমে কাস্ত্রোর সঙ্গে বইটা এই সময়ের মধ্যে শেষ করে ফেলতে পারব। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য, হাসান আজিজুল হকের আত্মজা ও একটি করবীগাছও জোগাড় করেছি। সংগ্রহ করেছি আকবর আলি খানের দুটো বই। এই ফাঁকে যদি পড়ার অভ্যাসে ফেরা যায়।
দুই.
দুমকিতে আজ কদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। আজও এসেছে। করোনাভাইরাসে এখানে আক্রান্ত হয়েছিলেন পাঁচজন। একজন মারা গেছেন। সারা দুনিয়ার মোট মৃত্যুর তুলনায় সংখ্যাটি নগণ্য। কিন্তু তার পরিবারের কাছে এই সংখ্যা একজন জলজ্যান্ত মানুষ।
মানুষজন এক মাসের বেশি সময় ধরে ঘরে। পেটের ক্ষুধায় যাঁরা রাস্তাঘাটে কাজ করছিলেন, বৃষ্টির তোড়ে তাঁরাও বাধ্য হয়ে এখন ঘরে। অনেকের ঘরে খাবার আছে, অনেকের ঘরে নেই। কিন্তু সবাই এখন ঘরে। আমরা কি মেনেই নিয়েছি, বিরূপ পরিস্থিতিতেও দুনিয়ার কিছু মানুষ সামলে নেওয়ার শক্তিতে টিকে থাকবে; আর কিছু মানুষ জরা, ব্যাধি আর অনাহারে লুটোপুটি খাবে?
তিন.
করোনাভাইরাসের প্রকোপ চলে যাওয়ার পরে দুনিয়ার কী হাল হয়, কে জানে! অর্থনীতি ধসে পড়লে চাকরি–বাকরি পাওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়বে নিশ্চয়ই। আমাদের বন্ধুবান্ধব বা সমসাময়িক যাঁরা এত দিন বিদেশে যাওয়ার চিন্তায় মগ্ন ছিলেন, তাঁদের সামনে এখন পর্বতপ্রমাণ চ্যালেঞ্জ। সময়টা পার হলে তাঁদের আগের ভাবনা–চিন্তায় ছেদ পড়বে নিশ্চয়ই। অনেকে চাকরিও হারাবেন। কবে যে আবার বিসিএস পরীক্ষা হয়, কে জানে!
মাঝেমধ্যে ভাবি লেখক হওয়া যায় কি না। কিন্তু লেখক হতে হলে ভাবতে হয়। কাছে থেকে জীবনের আনন্দ–বেদনা দেখতে হয়।
চার.
২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায়ের ২৮তম প্রয়াণ দিবস পার হলো। তাঁর অনেক ছবি দেখেছি৷ এখনো বেশ কিছু বাকি রয়ে গেছে। কিছুদিন আগে দেখেছি কাঞ্চনজঙ্ঘা। মনে হলো, ছবিটা আরও আগেই দেখা উচিত ছিল।
ছবির মূল কাহিনি একটা অবস্থাপন্ন পরিবারকে ঘিরে। বড় মেয়েটিকে তারা পয়সাওয়ালা ছেলের সঙ্গেই বিয়ে দিয়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘায় বেড়ানোর ছুতোয় ছোট মেয়েটিকেও নিয়ে গেছে বিলেতফেরত বিরাট ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। কিন্তু মেয়েটি সেই মস্ত পয়সাওয়ালাকে পছন্দই করে উঠতে পারল না। উল্টো পছন্দ করে বসল এক বেকার যুবককে, যার কিনা বলার মতো কিছুই নেই।
সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলোতে কিছু বিষয় বেশ ঘুরেফিরে আসে। এই যেমন তাঁর নায়কেরা পড়াশোনা শেষ করে চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছে, কিন্তু চাকরি হচ্ছে না। কোথাও আবার নায়ক চাকরি খোয়াচ্ছে। নায়কের বেকার দশায় নায়িকার সঙ্গে সম্পর্ক ছুটে যাচ্ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে কিন্তু সত্যজিৎ রায় দেখালেন একদম উল্টো ছবি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক মেয়ে জীবনের বাকি পথ চলতে বেছে নিল এক বেকার যুবককে।
পাঁচ.
মেয়েটিকে আমি বেশ পছন্দ করি। বাড়িতে আসার আগে আমাকে বলেছিল, একজনের সঙ্গে ওর ভাব বিনিময় হচ্ছে। তবে এখনো কিছু হয়ে ওঠেনি। বলেছিল, এক মাসের মধ্যে আমাকে একটা সুসংবাদ দিতে পারবে হয়তো। আজ এক মাস পাঁচ দিন। এখনো কোনো সুসংবাদ আসেনি।
গীতিকবি শেখ রানার গানের একটা লাইন অনেকটা এ রকম: পার্থিবতায় বাস করে আমি শুধু অপার্থিবতার সন্ধান করে গেলাম। দু দণ্ড জিরিয়ে পার্থিবতায় ফিরে আসার ফুরসত আমার হলো না।