চট্টগ্রাম নগরের ব্রিজঘাট এলাকায় ১৯৯০ সালে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ছিল প্রায় ৯০০ মিটার। এই ঘাটের কাছাকাছি চাক্তাই এলাকায় ২০০৬ সালে শুরু হয় শাহ আমানত তৃতীয় সেতুর নির্মাণকাজ। ৯৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটির আশপাশে জেগে ওঠা চর দখল করে বস্তি, পাকা অবকাঠামোসহ নানা স্থাপনা গড়ে ওঠে। তারও ছয় বছর আগে নদীর জায়গা ইজারা দেওয়া হয় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র তৈরির জন্য। ফলে সেতু এলাকায় নদীর প্রস্থ কমে হয়েছে প্রায় ৫১০ মিটার।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামে একটি সংগঠন গত আগস্ট মাসে শাহ আমানত তৃতীয় সেতু থেকে শুরু করে ফিরিঙ্গী বাজার মনোহরখালী খাল পর্যন্ত একটি জরিপ চালায়। তাতে দেখা যায়, সেতু এলাকায় জোয়ারের সময় নদীটির প্রস্থ ৫১০ মিটার আর ভাটার সময় ৪১০ মিটার। ২০১৪ সালে এডিবির পরিমাপ অনুযায়ী, সেতু এলাকায় নদীর প্রস্থ ছিল ৮৮৬ মিটার। চাক্তাই খালের মুখে প্রস্থ ছিল ৮৯৮ মিটার, পরে কমে হয়েছে ৪৩৬ মিটার।
অব্যাহত দখল, অবকাঠামো নির্মাণ, চর জেগে ওঠাসহ নানা কারণে ৩০ বছরে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ কমেই চলেছে। দখলের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ জড়িত। নদীর জায়গা অবৈধভাবে ইজারা দিয়ে এই সংকোচনে ভূমিকা রেখেছে চট্টগ্রাম বন্দরও। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে এখন পর্যন্ত নদীর প্রায় ২৫ একর জায়গা ইজারা দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকঢোল পিটিয়ে কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়েছিল। দুই দফা উচ্ছেদ অভিযানে সদরঘাট ও পতেঙ্গা লালদিয়ার চর এলাকায় প্রায় ৪০ একর ভূমি উদ্ধার করা হয়। এরপর ১৩ মাস ধরে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসন এ নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করছে। আদালতে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রিট তো আছেই। ফলে উদ্ধার করা জায়গা নতুন করে দখল করতে কারও বেগ পেতে হয়নি।
চট্টগ্রামের সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের অধ্যাপক ইদ্রিস আলী দীর্ঘদিন ধরে কর্ণফুলী নদীর স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করছেন। কর্ণফুলীর ওপর তাঁর গবেষণা প্রতিবেদনটি নর্থ আমেরিকান রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়, অতীতে কালুরঘাট থেকে মোহনা পর্যন্ত নদীর গড় প্রস্থ ছিল ৬০০ থেকে ৯০০ মিটার। শাহ আমানত সেতু করার সময় এবং খননের সময় প্রস্থ কমে আসে। এখন শাহ আমানত সেতু এলাকায় এর প্রস্থ ৫২০ মিটার। ২০১০ এর আগে ছিল ৯০০ মিটার।
অধ্যাপক ইদ্রিস আলী প্রথম আলোকে বলেন, দখলের কারণে নদীটির ভৌগোলিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর প্রস্থ কমে গেছে ৫০ থেকে ২৫০ মিটার পর্যন্ত। দখল ও দূষণের কারণে এর নাব্যতা এবং দৈহিক ক্ষতি হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, এই নদীর অবৈধ স্থাপনা ২ হাজার ১১২টি। তবে গত পাঁচ বছরে অবৈধ স্থাপনা আরও বেড়েছে বলে ইদ্রিস আলী মনে করেন।
দখলের কারণে নদীটির ভৌগোলিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর প্রস্থ কমে গেছে ৫০ থেকে ২৫০ মিটার পর্যন্ত। দখল ও দূষণের কারণে এর নাব্যতা এবং দৈহিক ক্ষতি হয়েছে।অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, অধ্যাপক, সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম
আদালতের নির্দেশ আছে, পাড়সহ নদীর জায়গা কোনোভাবেই ইজারা বা হস্তান্তর করা যাবে না। কিন্তু এ নির্দেশ মানছে না বন্দর। বিভিন্ন সময় চট্টগ্রাম বন্দর কিছু সংস্থাকে নদীসংলগ্ন এলাকা ইজারা দিয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি ইনকনট্রেড কনটেইনার ডিপোকে দিয়েছে ১৯ দশমিক ৬ একর জায়গা। আর ফিশারিঘাট নতুন মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রকে দিয়েছে ৪ একর। জেলা প্রশাসন এ নিয়ে গত বছর প্রশ্ন তুলেছিল। তবে বন্দরসচিব ওমর ফারুকের ভাষ্য, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ইজারা দেওয়া হয়েছে।
গত বছর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার কর্ণফুলী নদীর দখলকৃত স্থাপনা এবং ইজারা দেওয়া স্থানগুলো ঘুরে দেখেন। তিনি এ সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে ইজারা বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নদীর জায়গা ইজারা দেওয়ার এখতিয়ার কখনোই কারও ছিল না। সুপ্রিম কোর্ট সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন, নদীর জায়গা কেউ লিজ বা হস্তান্তর করতে পারবে না। কিন্তু বন্দর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নদীর জায়গা ইজারা দিয়েছে অবৈধভাবে। জেলা প্রশাসনও দিয়েছে। এতে সংকুচিত হচ্ছে কর্ণফুলীর গতিপথ।
৩০ থেকে ৪০ বছর ধরে লালদিয়ার চরে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। বিভিন্ন জেলা থেকে নিম্ন আয়ের লোকজন এসে সেখানে বসতি গড়ে তোলে। পতেঙ্গা ভূমি কার্যালয়ের হিসাবে ২০১৫ সালে অবৈধ স্থাপনার যে তালিকা হয়েছে, তার মধ্যে লালদিয়ার চর, চর বস্তিয়া ও বিজয় চরে প্রায় দেড় হাজারের বেশি স্থাপনা রয়েছে।
লালদিয়ার চরে বর্তমানে প্রায় ৭০ একর জায়গায় ১ হাজার ২০০ পরিবার বসবাস করছে। তাদের নেতা পতেঙ্গা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আলমগীর হাসান। তাঁর দাবি, লালদিয়ার চরে অবৈধ দখলদার নেই। যাঁরা বিমানবন্দর হওয়ার সময় জমি পেয়েছিলেন, তাঁরা কিছু ঘর ভাড়া দিয়েছেন। এখানে দখলস্বত্ব বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, উচ্ছেদ করা জায়গা যাতে বেদখল না হয়, সেদিকে উচ্ছেদকারী সংস্থা বন্দর ও জেলা প্রশাসনকে
খেয়াল রাখতে হবে। উচ্ছেদ ও সংরক্ষণ একসঙ্গে হতে হবে। কর্ণফুলীকে ঘিরে একটা মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। কোথায় কীভাবে জায়গা সংরক্ষণ করা হবে, তা মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী করার কথা রয়েছে।
কর্ণফুলী নদীর তৃতীয় সেতুর আশপাশে জেগে ওঠা চর দখল করে বস্তি-বাণিজ্য করার অভিযোগ উঠেছে সরকারি দলের কয়েকজনের বিরুদ্ধে। ছিন্নমূল দরিদ্র লোকজনকে ভাড়া দিয়ে চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মুখে অন্তত ৩০ একর সরকারি খাসজমি ২০ বছর ধরে দখল করেছেন তাঁরা।
দখল সুসংহত করার জন্য গঠন করা হয়েছে ‘ভেড়া মার্কেট শ্রমজীবী সমবায় কল্যাণ সমিতি’ নামে একটি সংগঠন। সমিতির নেতা বকশিরহাট ওয়ার্ড যুবলীগের সহসভাপতি আকতার হোসেন। তাঁকে ফোন করে পাওয়া যায়নি। উচ্ছেদ ঠেকাতে আকতার হোসেন ২০১৪ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। ওই রিট এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
এ ছাড়া বকশিরহাট ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আমিন তৃতীয় সেতু–সংলগ্ন কলেজ রোড এলাকায় নদীর জায়গা দখলে রেখেছেন। তাঁর কলোনির নাম ‘শান্তি কলোনি’। ভাড়াটে রয়েছেন প্রায় ৫০ জন। জানতে চাইলে নুরুল আমিন বলেন, ‘আমি ওখানে জায়গা কিনেছি। তবে কিছু জায়গা উচ্ছেদ তালিকায় পড়েছে।’
বাকলিয়া বহুমুখী বাস্তুহারা কলোনির নামে অন্তত ৫০ একর জমি দখলে রয়েছে। জসিম উদ্দিন নামে বিএনপির এক নেতা এই জমি প্রথম বেচাকেনা করেন। এখন এই কলোনি দেখভাল করেন উত্তম কুমার সুশীল। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে সদরঘাটের নাম। এলাকার নামও এই ঘাটের নামে। হাজার বছরের চট্টগ্রাম বইয়ের তথ্যমতে, ১৮৬০ সালে এই ঘাটে চট্টগ্রাম বন্দর জেটি নির্মাণ করা হয়েছিল। খেয়া পারাপারে সব সময় ব্যস্ত সময় পার করে ঘাটটি। দেড় বছর আগে ঘাটটির পাশে ছিল সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতির কার্যালয়সহ নানা অবৈধ স্থাপনা। ছিল বালু ও পাথরের ব্যবসা।
গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সময় বুলডোজারের উদ্বোধনী ধাক্কাটি লাগে এই ঘাটের অবৈধ স্থাপনার ওপর। তবে অবমুক্ত করা জায়গা পুনরায় দখল হয়েছে বালু আর পাথরের স্তূপে। জেঁকে বসেছে রিকশার গ্যারেজ। ঘাটের ইজারাদার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবু কায়সার এই দখলের সঙ্গে জড়িত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সামান্য কিছু বালু রাখা হয় মাঝেমধ্যে। ও রকম কোনো স্থাপনা করা হয়নি।
সদরঘাট থেকে পতেঙ্গার লালদিয়ার চরের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। কয়েক দশক আগে থেকে অবৈধ দখলদারদের ছোবল পড়েছে এখানে। গত বছরের ২২ জুলাই চরের এ ব্লকে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয়েছিল ৩০ একর জমি। ২ সেপ্টেম্বর দুপুরে দেখা যায়, পুনর্দখল ঠেকাতে একটা সীমানাদেয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে এ ব্লকের এক পাশে। তবে অন্য পাশে ভেঙে দেওয়া অনেক দোকান ও ঘর আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছে।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদের একটি রিটের পর হাইকোর্ট কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট। এর আগের বছর হাইকোর্টের নির্দেশে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন নদীপারের ২ হাজার ১১২টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দিয়েছিল।
আদালতের নির্দেশের তিন বছর পর গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়। এরপর থেমে থেমে চলে অভিযান। পরে উচ্চ আদালতের আরেক নির্দেশনায় চট্টগ্রাম বন্দরকে উচ্ছেদের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ জন্য জেলা প্রশাসনের সহযোগিতাও নিতে বলা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে একটা স্থবির অবস্থা ছিল। এখন উচ্ছেদ কার্যক্রম আবার শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ও নগর–পরিকল্পনাবিদ আলী আশরাফ প্রথম আলোকে বলেন, বন্দর ও জেলা প্রশাসন দায়সারাভাবে দায়িত্ব সাড়ছে। এত দিন উচ্ছেদ বন্ধ থাকবে কেন? দখলদার যতই ক্ষমতাবান বা দলীয় হোক না কেন, নদী ও বন্দর বাঁচাতে উচ্ছেদ করতে হবে। কিন্তু প্রশাসন তা করছে না, বরং জেগে ওঠা চর অবৈধভাবে ইজারা দিচ্ছে। তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। এটা মেনে নেওয়া যায় না।