দুধের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রস্তুত হচ্ছে ক্রিম

করোনাভাইরাসের কারণে ফরিদপুরের তরল দুধ বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অল্প কিছু বিক্রি হলেও দাম কমে অর্ধেকে নেমে আসে। লোকসানের বোঝা বাড়তে থাকে। উপায় না পেয়ে এখন বিকল্প পথে যাচ্ছেন খামারিরা। দুধ থেকে ক্রিম তৈরি করছেন তাঁরা। খামারিদের এ কাজে সহযোগিতা করছেন ফরিদপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়। ছবি: সংগৃহীত
করোনাভাইরাসের কারণে ফরিদপুরের তরল দুধ বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অল্প কিছু বিক্রি হলেও দাম কমে অর্ধেকে নেমে আসে। লোকসানের বোঝা বাড়তে থাকে। উপায় না পেয়ে এখন বিকল্প পথে যাচ্ছেন খামারিরা। দুধ থেকে ক্রিম তৈরি করছেন তাঁরা। খামারিদের এ কাজে সহযোগিতা করছেন ফরিদপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়। ছবি: সংগৃহীত

সাবিনা ইয়াসমিন ফরিদপুরের কামারখালী উপজেলার দুধের খামারি। কামারখালীর আলিফ ডেইরি ফার্মের মালিক তিনি। প্রতিদিন ২০০ লিটারের বেশি দুধ উৎপাদন হয় তাঁর খামারে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সাবিনার খামারের উৎপাদিত দুধ বিক্রি বন্ধ হওয়ার জোগাড়। যাও–বা একটু–আধটু বিক্রি হচ্ছিল, দাম নেমে এসেছে অর্ধেকে। লোকসান এড়াতে বিকল্প পথ খুঁজে নিয়েছেন তিনি। অবশ্য সাবিনা একা নন, ফরিদপুরের বহু খামারি দুধ থেকে ক্রিম তৈরি করে রাখছেন। খামারিদের এ কাজে সহযোগিতা করছে ফরিদপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়।

জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানায়, ফরিদপুরে প্রতিদিন ১৫ হাজার লিটার দুধের উৎপাদন হয়ে থাকে। প্রতিবছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এই জেলার চরাঞ্চল, বিল এলাকায় মাষকলাইসহ বিভিন্ন জাতের ডালের চাষ হয়। খামারি ও কৃষকেরা এই সময়কে ‘কলাই’ মৌসুম বলে থাকেন।

এই মৌসুমে প্রচুর ঘাস পাওয়া যায়। এসব ঘাস গোখাদ্য হিসেবে বেশ উপকারী। এই ঘাস খেলে গাভির দুধ উৎপাদন বেড়ে যায়। তাই ‘কলাই’ মৌসুমে ফরিদপুর জেলায় দুধ উৎপাদন হয় প্রায় ২০ হাজার লিটার। ভরা মৌসুমের খামারিদের মাথায় হাত।

ফরিদপুরের বেশ কয়েকজন খামারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সপ্তাহখানেক আগে জেলার বিভিন্ন এলাকায় গুজব ছড়ায়। গুজবে ছিল, দুধ, ডিম, মাছ, মাংস খেলে করোনাভাইরাস হয়। এই গুজবের কারণে দুধ, ডিম, মাছ, মাংস বিক্রি বেশ কমে যায়। দুধের দাম লিটারপ্রতি ৫০ থেকে ২৫ টাকায় নেমে আসে। অনেক এলাকায় প্রতি লিটার দুধ ১২ টাকায় নেমে আসে। তখন খামারিরা জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন। প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে জেলার সিভিল সার্জনের মতামত চাওয়া হয়। তিনি বলেন, দুধ, ডিম, মাছ ও মাংস খেলে মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ে।

এরপরই প্রশাসনিকভাবে এই গুজব ঠেকাতে কার্যক্রম শুরু করে জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়। এই কার্যক্রমের ফলে দুধ, মাছ, মাংস, ডিম বিক্রি কিছুটা বাড়লেও আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি। প্রচুর পরিমাণে দুধ অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। তাই জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের পক্ষ থেকে খামারিদের ক্রিম তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে একটি ক্রিম তৈরির মেশিন চালু করা হয়েছে। এক দিনে ৫০০ লিটার দুধ থেকে ক্রিম তৈরি করা হয়েছে।

ফরিদপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নূরুল্লাহ মো. আহসান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘২২ মার্চ প্রাণিজ খাবারে করোনাভাইরাস হয়—এ ধরনের গুজব ছড়ানোর বিষয়টি আমার নজরে আসে। প্রচারপত্রও পাওয়া যায়। আমরা সিভিল সার্জন ও ঢাকায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে কথা বলে মতামত নিই। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ খেতে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এসব পরামর্শ আমরা দিতে থাকি। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ থাকায় এখন দুধ বিক্রি বেশ কম হচ্ছে। মিষ্টির দোকানগুলোও বন্ধ। তাই আমরা খামারিদের দুধ নষ্ট না করে ক্রিম তৈরির পরামর্শ দিচ্ছি।’

করোনাভাইরাসের কারণে ফরিদপুরের তরল দুধ বিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অল্প কিছু বিক্রি হলেও দাম কমে অর্ধেকে নেমে আসে। লোকসানের বোঝা বাড়তে থাকে। উপায় না পেয়ে এখন বিকল্প পথে যাচ্ছেন খামারিরা। দুধ থেকে ক্রিম তৈরি করছেন তাঁরা। খামারিদের এ কাজে সহযোগিতা করছেন ফরিদপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়। ছবি: সংগৃহীত

নূরুল্লাহ মো. আহসান বলেন, একটি প্রকল্পের আওতায় প্রায় পাঁচ বছর আগে ক্রিম তৈরির একটি মেশিন পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এর ব্যবহার তেমন হতো না। সেই মেশিন সদর উপজেলার এম এম বি জামানের খামারে রাখা হয়েছে। এই খামারে বিভিন্ন এলাকার খামারিরা দুধ এনে ক্রিম তৈরি করিয়ে নিচ্ছেন। বৃহস্পতিবার ১০ থেকে ১২ জন খামারি ৫০০ লিটার দুধ থেকে ক্রিম তৈরি করিয়েছেন। প্রতি ঘণ্টায় ১০০ লিটার দুধ থেকে ক্রিম করানো যায়। এই পরিমাণ দুধ থেকে ৩০ লিটারের মতো ক্রিম হয়। তবে মেশিন পুরোনো হওয়ায় দীর্ঘ সময় চালু রাখা যাচ্ছে না। এ জন্য আরও কয়েক মেশিন কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবশ্য বেশ কয়েকজন খামারি নিজ উদ্যোগে ক্রিম তৈরির মেশিনটি কিনতে যাচ্ছেন।

ক্রিম তৈরির কারণ জানতে চাইলে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জানান, ক্রিম তৈরির পর ডিপ ফ্রিজে রেখে দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায়। আবার ফ্রিজে না রেখে ঘি বা পনির করা যায়। করোনাভাইরাসের কারণে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় দুধ প্রক্রিয়াজাত করে এভাবে সংরক্ষণ করা যায়। ক্রিম থেকে ঘি ছাড়াও মাখন, ছানা তৈরি করা যায়। এসব খাবারের দামও ভালো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এর চাহিদাও বাড়বে। পুরো কার্যক্রম ফরিদপুর জেলা ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে করা হচ্ছে।

খামারিরা জানান, ১ কেজি ক্রিম ২৫০ টাকা। ক্রিম থেকে ঘি করা হলে দাম এক হাজার টাকার বেশি হয়। ঘি ফ্রিজে না রেখেও স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা যায়। এ কারণেই আলিফ ডেইরি ফার্মের মালিক সাবিনা ইয়াসমিন দুধ প্রক্রিয়াজাত করা মেশিন কিনে আনছেন। তিনি বলেন, ‘ক্রিম তৈরির কাজ হচ্ছে ফরিদপুর সদরে। এখান থেকে কামারখালীর দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। দুধ নিয়ে সেখান থেকে ক্রিম করে আনতে প্রচুর সময় লাগবে। সনাতন পদ্ধতিতে একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণে দুধ থেকে ক্রিম তৈরি করা যায় না। এখন গরম পড়ায় দুধ দূরের পথে আনা-নেওয়া করা হলে নষ্টও হয়ে যেতে পারে। তাই ক্রিম তৈরির মেশিন কিনব।’

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) জানায়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিদিন ১২০ লাখ থেকে ১৫০ লাখ লিটার দুধ অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। এতে দেশের খামারিদের প্রতিদিন প্রায় ৫৭ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। আগামী এক মাস এ অবস্থা চলতে থাকলে এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। কয়েক দিন ধরে প্রান্তিক পর্যায়ের কোথাও কোথাও খামারিরা প্রতি লিটার দুধ ১০ থেকে ১২ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। অনেকে দুধ বিক্রিও করতে পারছেন না। তবে বর্তমান পরিস্থিতে বরিশাল, পাবনাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় খামারিরা দুধ থেকে ক্রিম তৈরি করে রাখছেন। কয়েকটি জেলায় বেশ কিছু মেশিন পাঠানো হয়েছে।

বিডিএফএর সভাপতি ইমরান হোসেন বলেন, বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে তিন লাখ দুগ্ধ খামারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল। দেশের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতের তিনটি বড় কোম্পানির প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে গুঁড়া দুধ তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। একই সঙ্গে আরও ১০ থেকে ১২টি কোম্পানির ঘি, মাখন, ফ্লেভারড মিল্ক, আইসক্রিম, ক্রিম তৈরি করতে পারে। করোনাভাইরাস সমস্যায় আক্রান্ত পরবর্তী সময় এবং আসন্ন রমজান মাসে দেশে দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের সংকট দেখা দিতে পারে। তাই বর্তমানে দুধ ও দুগ্ধজাতীয় পণ্য মজুত করলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি দেশের খামারশিল্পকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।