দিনাজপুর শহরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দৌরাত্ম্যে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। পৌরসভা ৪ হাজার অটোরিকশাকে নিবন্ধিত করেছে। এখতিয়ার না থাকার সত্ত্বেও উপজেলা কর্তৃপক্ষ আরও সাড়ে ৩ হাজার অটোরিকশাকে নিবন্ধন দেয়। এতেই শুরু হয় জটিলতা।
এই দুই কর্তৃপক্ষের টানাটানিতে দুই বছর ধরে দিনাজপুর শহরে চলাচলকারী অটোরিকশার নিবন্ধন, নবায়ন বন্ধ রয়েছে। তবু সড়কে তিন চাকার এ যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ফলে বাড়ছে শহরবাসীর দুর্ভোগ। নিবন্ধনহীন এসব অটোরিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও যেন কেউ নেই।
উপজেলায় অটোরিকশার নিবন্ধন দিয়েছেন দিনাজপুর সদর উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদুল ইসলাম। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। আর পৌর মেয়রের দায়িত্বে আছেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক।
দিনাজপুর শহরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারেন না। মালিক পক্ষের হিসাবে, এই সংখ্যা ১৫ হাজার। আরেক পক্ষ বলছে, এই গাড়ি ২০ হাজার হবে। স্থানীয়ভাবে ‘ইজিবাইক’ নামে পরিচিত এসব অটোরিকশাচালকদের কোনো লাইসেন্স নেই, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেই। বেপরোয়া চালানো, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানোয় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। ১৮ এপ্রিল দিনাজপুর সদর উপজেলার চুনিয়াপাড়া এলাকায় একটি বাস অটোরিকশাকে চাপা দেয়। এতে মারা যান অটোরিকশার তিন যাত্রী। এই ঘটনার পর শহরে অবৈধ অটোরিকশার দৌরাত্ম্য নিয়ে সব মহলে আলোচনা শুরু হয়।
দিনাজপুর পৌরসভা ও উপজেলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর দিনাজপুর জেলা শহরে চলাচলকারী ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ–সংক্রান্ত সভায় ১৪টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শহরে চলাচলের জন্য পৌরসভার মাধ্যমে ৪ হাজার অটোরিকশাকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
সিদ্ধান্তমোতাবেক, ২০১৬ সালের শেষে এবং ২০১৭ সালের শুরুতে দিনাজপুর পৌরসভা প্রতিটি অটোরিকশার কাছ থেকে ২ হাজার ৮৭৫ টাকা করে নিবন্ধন ফি নিয়ে ৪ হাজার অটোরিকশাকে নিবন্ধন দেয়। প্রতিবছর এই নিবন্ধন নবায়নের কথা ছিল। পৌরসভা মূলত এর আওতাধীন ১২টি ওয়ার্ডের অটোরিকশাগুলোকে নিবন্ধন দেয়।
এর কিছুদিন পর উপজেলা চেয়ারম্যান ফরিদুল ইসলাম উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে চলাচলকারী সাড়ে ৩ হাজার অটোরিকশাকে নিবন্ধন দেন। এই অটোরিকশাগুলোও শহর এলাকায় চলাচল করে।
এ বিষয়ে পৌরসভার মেয়র জাহাঙ্গীর আলম গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, পৌরসভার কর বিধিমালা অনুযায়ী সাধারণ ব্যবসায় ব্যবহৃত যানবাহনের কর আরোপ ও নিবন্ধন করার নির্দেশনা আছে। উপজেলার এখতিয়ারে না থাকলেও তারা অটোরিকশার নিবন্ধন দিয়েছে। এ বিষয়ে নানা আলোচনার কারণে এখন আর নিবন্ধন নবায়নও হচ্ছে না।
উপজেলায় নিবন্ধিত অটোরিকশাগুলোর বিষয়ে সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফরিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, ‘পৌরসভা তার মতো করে নিবন্ধন দিয়েছে। ইউনিয়নে চলাচলকারী অটোরিকশাগুলোর জন্য উপজেলা নিজের মতো করে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করে।’ কোন ক্ষমতাবলে নিবন্ধন দিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
উপজেলা থেকে নিবন্ধন পাওয়া ছয়টি অটোরিকশার মালিক ও ছয়জন চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি অটোরিকশা নিবন্ধন করতে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে দিতে হয়েছে।
বুধ ও বৃহস্পতিবার শহর ঘুরে দেখা যায়, শহরের প্রতিটি মোড়, শিক্ষা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতানের সামনে অটোচালকেরা দাঁড়িয়ে আছেন যাত্রীর অপেক্ষায়। পুরো শহরটাই যেন অটোরিকশার স্ট্যান্ড। বিপজ্জনকভাবে সড়কের মাঝে যাত্রী ওঠানো-নামানো হচ্ছে। অনেক অটোরিকশায় সন্ধ্যার পর হেডলাইট জ্বলে না। ইন্ডিকেটর বা সংকেতবাতি নেই।
শহরের গণেশতলা এলাকার বাসিন্দা আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘খুব বেপরোয়াভাবে অটোগুলো চলে। কোনো সিগন্যাল না দিয়ে হুটহাট থেমে যায়। অটোরিকশার সংখ্যা এত বেশি যে যাত্রী তোলার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা হয়।’
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৬ সালের শহরে চলাচলকারী অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ১৪টি সিদ্ধান্তের ১২টি সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত হয়নি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো চালকদের লাইসেন্স দেওয়া, নিবন্ধিত অটোরিকশা জোড় ও বিজোড় হিসেবে দুই পাল্লায় চলবে, বাইরের কোনো অটোরিকশা পৌর এলাকায় চলতে পারবে না, অটোরিকশার জন্য স্ট্যান্ডের ব্যবস্থা করা।
জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি শফিকুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অটোরিকশা নিবন্ধন দিয়ে কর্তৃপক্ষ কিছু টাকা উপার্জন করেছে, কিন্তু কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেনি। দিনে দিনে অটোরিকশার সমস্যা প্রকট হয়েছে। জনস্বার্থে দ্রুত সড়কের যানবাহনের ধারণক্ষমতা, জনগণের চাহিদা বিবেচনায় রেখে অটোরিকশাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বজলুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে বসে এ সমস্যার সমাধান করা হবে।