দানের টাকায় সেতু বানাচ্ছেন ভিক্ষু

চলছে সেতু নির্মাণের কাজ। তদারক করছেন ভিক্ষু পঞ্ঞ চক্ক মহাথের। সম্প্রতি চট্টগ্রামের রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের বড়ুয়াপাড়া গ্রামে। প্রথম আলো
চলছে সেতু নির্মাণের কাজ। তদারক করছেন ভিক্ষু পঞ্ঞ চক্ক মহাথের। সম্প্রতি চট্টগ্রামের রাউজানের কদলপুর ইউনিয়নের বড়ুয়াপাড়া গ্রামে।  প্রথম আলো

পাশাপাশি দুই ইউনিয়নের মধ্যে দূরত্ব মাত্র ৩০০ মিটার। ইউনিয়ন দুটিকে পৃথক করেছে বিস্তীর্ণ ধানখেত আর ডোবা। যা বছরের বেশির ভাগ সময় ডুবে থাকে পানিতে। ফলে এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়নে যেতে ঘুরতে হয় প্রায় চার কিলোমিটার পথ। একটি সেতুর অভাবে দীর্ঘদিন ধরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন দুই ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার বাসিন্দা।

অবশেষে তাঁদের কষ্টের অবসান হতে যাচ্ছে। এগিয়ে এসেছেন পঞ্ঞ চক্ক মহাথের নামের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু। বিল আর ডোবার ওপর সেতু বানাচ্ছেন তিনি। তাঁর প্রচেষ্টায় ৫০ লাখ টাকায় নির্মিত হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ১০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫ ফুট প্রশস্তের এই সেতু। এর মধ্যে ৫০৮ ফুটের কাজ শেষ। এখন চলছে ১৮০ ফুটের কাজ।

জনদুর্ভোগ লাঘবে ব্যক্তি উদ্যোগে সেতু নির্মাণের এ নজির সৃষ্টি হচ্ছে চট্টগ্রামের রাউজানে। সেতুটি যুক্ত করবে উপজেলার পাহাড়তলী ও কদলপুর ইউনিয়নকে।

দুই ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকা খৈয়াখালী গ্রাম। পাহাড়তলী ইউনিয়নের এই গ্রামে আছে একটি অনাথালয়, একটি বৌদ্ধবিহার, একটি উচ্চবিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়।

সেতু নির্মাণে অর্থ দান করছেন দুই ভক্ত।

সরেজমিনে দেখা যায়, খৈয়াখালী গ্রামের ধম্মা বিজয়া রাম বিহারের পেছনে বিশাল ধানখেত। খেতের আইল ধরে চলাচল করেন দুই ইউনিয়নের বাসিন্দারা। তবে তা শুষ্ক মৌসুমে মাত্র দু–এক মাসের জন্য। এখন এই আইলের ওপরই নির্মিত হচ্ছে সেতুটি। সেতু নির্মাণে নিয়মিত ১২০ শ্রমিকের পাশাপাশি প্রায় ১০০ তরুণ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন।

একটি সেতু নির্মাণের জন্য বছরের পর বছর ধরে ধরনা দিয়ে আসছিলের এলাকার লোকজন। কিন্তু সরকারি কোনো দপ্তর বা জনপ্রতিনিধি কেউই সাড়া দেননি।

অবশেষে চক্ক মহাথের স্থানীয় মানুষের কষ্ট লাঘবে এগিয়ে আসেন। তিনি খৈয়াখালী উচ্চবিদ্যালয় ও খৈয়াখালী ধম্মা বিজয়া রাম বিহার পরিচালনা কমিটিরও সভাপতি।

সেতুটি নির্মাণের গল্প বলতে গিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক চক্ক মহাথের প্রথম আলোকে বলেন, গত ১১ জানুয়ারি সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেতু নির্মাণে সরকারি বরাদ্দ পাওয়া না গেলেও স্থানীয় বিত্তশালী লোকজন অর্থসহায়তা দিয়েছেন। সেতুর নাম দেওয়া হয়েছে ‘খৈয়াখালী-কদলপুর সংযোগ সেতু’।

বিনা পারিশ্রমিকে সেতুটির নকশা করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী উৎপল বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সেতুটি নির্মিত হলে যাতায়াতে দুর্ভোগ দূর হবে, কমবে বাড়তি পথ পাড়ি দেওয়ার ঝামেলা। কদলপুর থেকে পাহাড়তলী ইউনিয়নের খৈয়াখালী উচ্চবিদ্যালয় ও খৈয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে এক ঘণ্টা সময় লাগে শিক্ষার্থীদের। সেতু চালু হলে লাগবে মোটে ১০ থেকে ১৫ মিনিট।

স্বেচ্ছায় শ্রম দেওয়া সেকান্দর বাদশা ও কলেজপড়ুয়া নিশান চৌধুরী বলেন, ভালো কাজে শ্রম দিতে পেরে তাঁরা আনন্দিত।

এলাকাবাসী জানান, স্থানীয় বৌদ্ধবিহারটিতে প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। এর মধ্যে আছে ১৯ দিনব্যাপী ব্যূহ মেলা, কঠিন চীবর দান, আধি ধর্ম পাঠ ও বাংলা বর্ষবরণ। এসব অনুষ্ঠানে দুই ইউনিয়নের হাজারো বাসিন্দা অংশ নেন। অন্যান্য এলাকা থেকেও আসেন পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীরা। তাই সেতু নির্মাণ না করে উপায় ছিল না।

কদলপুর ইউনিয়নের বড়ুয়াপাড়া গ্রাম থেকে খৈয়াখালী বৌদ্ধবিহারে পূজা দিতে এসেছিলেন লক্ষ্মী বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘বর্ষাকালে বিল পানিতে ডুবে থাকে। তাই পূজা দিতে বিহারে আসতে পারেন না। এখন সেতু হলে খুব সহজেই আসতে পারবেন। এ জন্য ভান্তের প্রতি কৃতজ্ঞতা।’

পাহাড়তলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রোকন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তি উদ্যোগে এ ধরনের সেতু নির্মাণ উপজেলায় প্রথম।

রাউজান উপজেলা প্রকৌশলী আবুল কালাম বলেন, এই কাজের ফলে দুই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের জীবনমানে পরিবর্তন আসবে।