যশোরের অভয়নগরে বিতরণ করা ত্রাণের প্যাকেটে ওজনে কম চাল দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার চালের সঙ্গে শুকনো খাবার বিতরণের জন্য যে নগদ অর্থ দেওয়া হয়েছিল, তার হিসাবেও গরমিল দেখা গেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলেছেন।
ইউএনও কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় অভয়নগর উপজেলার আটটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার জন্য সাধারণ ত্রাণ (জিআর) বাবদ ১৪৪ মেট্রিক টন চাল, শুকনো খাবারের জন্য (আলু, ডাল ও সাবান) নগদ ৫ লাখ ৫১ হাজার টাকা এবং শিশুখাদ্য বাবদ আরও ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত ২৭ মার্চ থেকে ২ মে পর্যন্ত সাত কিস্তিতে এই বরাদ্দ দেওয়া হয়।
তবে চেয়ারম্যানরা জানান, সাধারণত তাঁরা উপজেলা খাদ্যগুদাম থেকে তাঁদের নামে বরাদ্দের চাল (৫০ কেজির বস্তা) তুলে এনে বিতরণ করেন। এবার ইউএনও নিজেই তাঁদের বরাদ্দের চাল তুলে খাদ্যগুদামের মধ্যে শ্রমিকদের দিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর উপহার’ লেখা ১০ কেজির প্যাকেটে প্যাকেট করছেন। পরে তাঁদের ওই প্যাকেট সরবরাহ করা হচ্ছে।
ইউপি চেয়ারম্যানরা জানান, চালের সঙ্গে নগদ টাকা বরাদ্দ আছে। ওই টাকা দিয়ে শুকনো খাবার কিনে দিতে হবে। কিন্তু ইউএনও ও পিআইও বরাদ্দের টাকা থেকে প্রথম কিস্তির এক হাজার চালের প্যাকেটের সঙ্গে এক কেজি করে আলু, ৪০০ গ্রাম ডাল এবং একটি ছোট সাবান কিনে দেন। মাঝের পাঁচ কিস্তিতে তাঁদের কোনো শুকনো খাবার কিনে দেওয়া হয়নি। তাঁদের প্রত্যেককে পৃথকভাবে কয়েক হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। শিশুখাদ্যের টাকা দিয়ে মিল্ক ভিটার ৪০০ গ্রাম ওজনের গুঁড়া দুধ কিনে পিআইওর দপ্তর থেকে সরবরাহ করা হয়েছে।
উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের মোট ১ লাখ ৮২ হাজার ৬৫০ টাকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ৮ হাজার টাকা, নওয়াপাড়া পৌরসভার মেয়র ৩৮ হাজার ৬০০ টাকা, প্রেমবাগ ইউপির চেয়ারম্যান ২২ হাজার টাকা, সুন্দলীর চেয়ারম্যান ১৩ হাজার ৫০০ টাকা, চলিশিয়ার চেয়ারম্যান ১৬ হাজার টাকা, পায়রার চেয়ারম্যান ১৭ হাজার ৭৫০ টাকা, শ্রীধরপুরের চেয়ারম্যান ২৮ হাজার টাকা, বাঘুটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ১৭ হাজার ৫০০ টাকা, শুভরাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ৮ হাজার টাকা এবং সিদ্দিপাশা ইউপি চেয়ারম্যানকে ১৩ হাজার ৩০০ টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রথম কিস্তিতে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে আলু, ডাল ও সাবান কিনে দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৩ লাখ ৮ হাজার ৩৫০ টাকার কোনো হদিস নেই।
শুভরাড়া ইউপির চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস বলেন, ‘উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু টাকা দেওয়ার সময় অফিস খরচ বাবদ ২ হাজার টাকা কেটে রাখা হয়েছে।’
শ্রীধরপুর ইউপির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী মোল্যা বলেন, ‘১২ মে পর্যন্ত আমার ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দ ২০ মেট্রিক টন ৩৮০ কেজি চাল পেয়েছি। ১১৪ প্যাকেট গুঁড়া দুধ পেয়েছি। দুই কিস্তিতে ২৮ হাজার নগদ টাকা পেয়েছি। ওই টাকা দিয়ে চালের সঙ্গে সবজি কিনে দিয়েছি।’
প্রেমবাগ ইউপির চেয়ারম্যান মো. মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘ইউনিয়নের সব বরাদ্দ আমার নামে। অথচ কোথাও আমার স্বাক্ষর লাগছে না। সেটা কীভাবে হচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছি না।’
কয়েকজন সুবিধাভোগীও অভিযোগ করেছেন, তাঁরা যে চাল পেয়েছেন, তা ওজনে কম। অভয়নগর গ্রামের দিনমজুর আবু হানিফ বলেন, ‘আমি ১০ কেজির এক প্যাকেট চাল পেয়েছি। বাড়িতে এসে ওজন করে দেখি সাড়ে ৮ কেজি চাল।’
পুড়াখালী গ্রামের ভ্যানচালক মিলন মোল্যা বলেন, তিনি প্যাকেটে ৭ কেজি চাল পেয়েছেন। দেয়াপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল মালেক বলেন, তিনি সাড়ে সাত কেজি চাল এবং এক কেজি পটোল পেয়েছেন।
জানতে চাইলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শরীফ মোহাম্মদ রুবেল মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি নামাজে আছি। পরে কথা বলছি।’ পরে তাঁর মুঠোফোনে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি কল ধরেননি।
ইউএনও মো. নাজমুল হুসেইন খাঁন দাবি করেন, বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ নিয়ে অনিয়ম হচ্ছে। অভয়নগরে তেমনটা হয়নি। ৫০ কেজির বস্তায় চাল দিলে চুরি করতে সুবিধা হয়। ১০ কেজির বস্তায় চাল চুরির সুযোগ নেই। এ জন্য ১০ কেজির বস্তায় চাল দেওয়া হয়েছে। ওজনও ঠিক আছে। তিনি দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহার লেখা চালের ব্যাগ করা হয়েছে। এতে খরচ হয়েছে। চেয়ারম্যানদেরও তাতে সম্মতি ছিল। দুই-তিনজন চেয়ারম্যান ব্যাগ করতে চাননি। তাঁরাই এসব অভিযোগ করছেন। তিনি বলেন, ‘ত্রাণের বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে ব্রিফ দিতে বলা হয়েছে। অনিয়ম হলে আমি যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’