জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘ত্বকীর মতো প্রতিভাবান ছেলেকে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হতে হলো, আর আমরা কিছুই করতে পারছি না। এই অক্ষমতা বড় বেশি করে বাজে। তবু আমরা হাল ছেড়ে দেব না। আমরা ত্বকী হত্যার বিচারের দাবি সব সময় করব।’
আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এসব কথা বলেন। সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ ‘জাতীয় ত্বকী চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতা-১৯’ শীর্ষক এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্যে আনিসুজ্জামান বলেন, ‘ত্বকী হত্যার পর আমরা প্রতিবছর এক থেকে দুবার সভা-সমিতির আয়োজন করে বিচার দাবি করেছি। এত দিনেও দাবি পূরণ হয়নি, এটা গভীর আক্ষেপের কথা।’ একদিন না একদিন ত্বকী হত্যার বিচার হবে বলে এই জাতীয় অধ্যাপকের আশা।
হস্তক্ষেপের কারণে ত্বকী হত্যার বিচার হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কেন বিচার হচ্ছে না, এই প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু আমরা জানি কেন বিচার হচ্ছে না। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। কিন্তু ত্বকীর ক্ষেত্রে হচ্ছে না। কেননা, এখানে হস্তক্ষেপ আছে এবং এই হস্তক্ষেপ কারা করছে, তাও আমরা জানি।’
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ত্বকী যদি বড় হতো, ধরা যাক সে বুয়েটে পড়তে আসত, সে যদি একটা রাষ্ট্রের নীতি সম্পর্কে মন্তব্য করত, তাহলেও তাকে নিহত হতে হতো, যেমনটা বুয়েটের আবরারের সঙ্গে হয়েছে। ত্বকীকে আমরা প্রতীক হিসেবে দেখতে পাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা চলছি, সেখানে কৈশোরের সম্ভাবনা ও নিরাপত্তা খুব সংকুচিত ও সংকটের মধ্যে আছে। এই রাষ্ট্রব্যবস্থা বদলাতে একটি কিশোর আন্দোলন দরকার।’
কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘ত্বকী মারা গেছে ছয় বছরের বেশি সময় হয়েছে। ত্বকীকে নিয়ে আয়োজিত অন্তত দুটি অনুষ্ঠানে আমি নিজে এসেছি। কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছি। যতবারই আমি অনুষ্ঠানে আসি, আমি জানি এই হত্যার বিচার হবে না। তার কারণ সবাই জানেন। কিন্তু এটি চলতে পারে না। একটি দেশে যখন বিচারহীনতার সংস্কৃতি চেপে বসে, তখন শিক্ষাদীক্ষারই-বা কী দাম থাকে।’
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি যখন চেপে বসে, যখন সমাজে অন্ধকার প্রতিষ্ঠা হয়, অপশক্তি যখন শক্তিশালী হয়, তখন সংস্কৃতি, শিক্ষা কোনো কাজে লাগে না। একটি হত্যার বিচার না হলে অসংখ্য হত্যা সংঘটিত হয়। সম্প্রতি কিছু হত্যাকাণ্ডের কথা শুনেছি। সেগুলো বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হচ্ছে।’
অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি দেশে যখন পুলিশ বাহিনী, বিচারব্যবস্থা থাকে, তখন যেকোনো অপরাধ স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ, বিচার হওয়া উচিত। তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কেন প্রয়োজন হবে? সব দেশে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, আমাদের দেশে কেন হচ্ছে না?’
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ বলেন, ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে, তার জন্য নয়, তার বাবাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। এ রকম ভয়ংকর শাস্তি যে, কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও পুত্রকে হত্যা করে তার বাবাকে সারা জীবন জ্বলে-পুড়ে মরতে হবে। ত্বকীর পরিবারের জন্য কান্নার কোনো বিরাম নেই।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘ত্বকী হত্যায় নারায়ণগঞ্জবাসী মর্মাহত। তাকে হত্যার উদ্দেশ্য নারায়ণগঞ্জকে স্তব্ধ করা, পরিবার ও নারায়ণগঞ্জবাসীকে থামিয়ে দেওয়া। ছয় বছর ধরে বলছি, বিচার চাচ্ছি। কিন্তু বিচার হচ্ছে না। বিচার হবে না—প্রায় ৯৯ ভাগ মানুষেরই ধারণা। নারায়ণগঞ্জবাসীও সেটাই মনে করে।’ সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের বিচার হয়েছে, নুসরাত হত্যার বিচার হয়েছে। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কোনো না কোনো সময়ে ত্বকী হত্যারও বিচার হবে।’
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বলেন, ‘রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে, তবে রাষ্ট্রে বসবাস করা মানুষ স্বাধীনতা পায়নি। আমরা ছয় মাসের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে দেখেছি, তবে সাত বছরেও ত্বকী হত্যার বিচারের অভিযোগপত্র দিয়ে বিচার শুরু হওয়ার নমুনা দেখছি না। আমাদের বিচার-প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের ইচ্ছাধীন। রাষ্ট্রের পরিচালকেরা যেভাবে ইচ্ছা করেন, সেভাবেই বিচারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করেন।’
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে জাতীয় ত্বকী চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ৬ জনকে ত্বকী পদক ও তিনটি গ্রুপে ৫২ জন শিক্ষার্থীকে পুরস্কার দেওয়া হয়। সারা দেশের প্রায় ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের সদস্যসচিব হালিম আজাদ, জাতীয় ত্বকী চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতা পরিষদের আহ্বায়ক জাহিদুল হক প্রমুখ।