তৈমুরের ‘ভুল কৌশল’, অটল ছিলেন আইভী

তৈমুরের কৌশল বুমেরাং হয়ে যায় ব্যক্তি আইভীর জনপ্রিয়তা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী অবস্থান এবং শহরে তাঁর দৃশ্যমান উন্নয়নের সামনে।

তৈমুর আলম খন্দকারের বাসভবনে গিয়ে তাঁকে মিষ্টিমুখ করান নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। গতকাল বিকেলে মাসদাইয়ের বাড়িতে

এবারও বড় ব্যবধানে জয়ী হওয়ার পর সব মহলেই আলোচনা হচ্ছে সেলিনা হায়াৎ আইভীর অটল সাহসিকতার কথা, যা তাঁকে আলাদা অবস্থান করে দিয়েছে নারায়ণগঞ্জে। অন্যদিকে ‘ভুল কৌশল’ এবং ‘ছায়া সমর্থন’ তৈমুর আলম খন্দকারের হারের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

ভোটের পর হারজিত নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়। নারায়ণগঞ্জেও হচ্ছে। তবে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নিয়েও আলোচনা আছে ভোটারদের মধ্যে।

এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সব কেন্দ্রেই ইভিএমে ভোট হয়েছে। ভোট দেওয়ার পদ্ধতি না জানায় অনেক ভোটার বিড়ম্বনার শিকার হন, বিশেষ করে নারী ভোটারদের বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে দেখা গেছে। আঙুলের ছাপ না মেলায় অনেকে ভোট না দিতে পেরে ফেরত যান, আবার অনেকে দুই-তিন দফার চেষ্টায় ভোট দিতে সক্ষম হন। এতে কোনো কোনো ভোটারের জন্য ৮ থেকে ১০ মিনিট সময়ও নষ্ট হয়। এর ফলে ভোটারদের দীর্ঘ সারি তৈরি হয়। ইভিএমের ভোট নিয়ে এই বিভ্রাটের জন্য ভোটাররা প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

ভোটের পর মেয়র পদে পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম ইভিএমকে ‘ভোট চুরির বাক্স’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিসি-এসপির মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের জুলুম নির্যাতন করা হয়েছে। আর নির্বাচন কমিশন ইভিএম দিয়ে ভোট চুরি করেছে।’ তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে ইভিএমের মাধ্যমে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার আহ্বান জানান।

নারায়ণগঞ্জ সিটির ভোট অন্য যেকোনো সিটির চেয়ে ব্যতিক্রম। বরাবরই এখানে শান্তিপূর্ণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হয়ে আসছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের দরকার ছিল ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে ভোটারদের ইভিএম পদ্ধতি সম্পর্কে জানাবোঝার আগ্রহ তৈরি করা। সেটি হয়নি। এ কারণে ভোটারদের মধ্যে ইভিএমে ভোট নিয়ে বড় ধরনের অস্বস্তি ও বিড়ম্বনা ছিল। ভোটের আগে মক (পরীক্ষামূলক) ভোট করা হয়েছিল, সেখানে তেমন উপস্থিতি ছিল না।

এবারও সেলিনা হায়াৎ আইভী জিতবেন, এমনটা ভোটের বেশ আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিরা। যদিও তাঁদের অপেক্ষা ছিল, ভোটে তৈমুর আলমের সঙ্গে আইভীর পার্থক্যটা কেমন হয়, সেটি দেখার। এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়।

দুই প্রার্থীর প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, সেলিনা হায়াৎ আইভী জিতেছেন ৬৬ হাজার ৫৩৫ ভোটের ব্যবধানে, যা গতবারের (২০১৬ সাল) চেয়ে ১৩ হাজার ৩২ ভোট কম। সেবার আইভী বিএনপির প্রার্থী আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেনকে হারিয়েছিলেন ৭৯ হাজার ৫৬৭ ভোটের ব্যবধানে। তার আগেরবার ২০১১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী আইভী আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমানকে হারিয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৪৯ ভোটের ব্যবধানে। হিসাবে দেখা যায়, এবার তৈমুর হারের ব্যবধানটা গত দুবারের তুলনায় কমাতে পেরেছেন।

যদিও আইভী ভোটের এ ব্যবধান কমার জন্য ইভিএমে ধীর ভোট, নারী ভোটারদের ভোট দিতে না পারার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটাও তো সত্য, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় আছি। এ ছাড়া নানা সমীকরণ আছে, জাতীয় পর্যায়ের প্রভাবও একটু পড়েছে। নানা ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হতে হয়েছে।’

তৈমুরের কৌশলে ‘ভুল’

নারায়ণগঞ্জ সিটির নির্বাচনে প্রধান দুই মেয়র প্রার্থীর প্রচারণা শুরু থেকেই পর্যবেক্ষণ করেছেন, এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের মূল্যায়ন হচ্ছে, এ নির্বাচনে তৈমুরের প্রচারকৌশল ছিল ভুল। ভোটে তৈমুর যা করেছেন, তার চেয়ে আরও ভালো করার সুযোগ ছিল। কিন্তু ভুল প্রচারকৌশলের পাশাপাশি একটি গোষ্ঠীর ছায়া হয়ে তাঁর নির্বাচনে নামার বিষয়টি ভোটারদের মধ্যে নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় বিএনপি তাঁর সঙ্গে পুরোপুরি ছিল না। স্থানীয় নেতাদের বড় একটি অংশকে ভোটের ব্যাপারে নির্লিপ্ত দেখা গেছে।

ভোটের ফলাফলে দেখা যায, বিএনপি সমর্থক কাউন্সিলররা যে নয়টি ওয়ার্ডে জিতেছেন, সেগুলোর কোনোটিতেও তৈমুর জিততে পারেননি। এমনকি তৈমুরের ছোট ভাই মাকছুদুল আলম প্রতিদ্বন্দ্বীকে ১২ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন। এটি তৈমুরের নিজের ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডেও আইভীর চেয়ে ১০৭ ভোট কম পেয়েছেন তৈমুর।

প্রচারের শুরু থেকে তৈমুর দাবি করেছেন, দল তাঁকে কৌশলগত কারণে পদচ্যুত করলেও তাঁর নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন আছে। স্থানীয় কিছু নেতা প্রচারে তাঁর সঙ্গে ছিলেনও। কিন্তু প্রচারণায় তৈমুর কোথাও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারণ করেননি। হারের পর যেভাবে সরকারের সমালোচনা করছেন, ভোটের প্রচারে এমন সমালোচনা তূলনামূলক কম শোনা গেছে। ফলে এই নির্বাচন যে সরকারদলীয় প্রার্থী বনাম বিরোধী দলের, নৌকা বনাম বিরোধী শিবিরের, সেটি তিনি ভোটারদের সামনে সেভাবে তুলে ধরতে পারেননি। বরং সরকারের সমালোচনার চেয়ে ভোটে তৈমুরের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন আইভী। কিন্তু তাঁর এই কৌশল বুমেরাং হয়ে যায় ব্যক্তি আইভীর জনপ্রিয়তা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী অবস্থান এবং শহরে তাঁর দৃশ্যমান উন্নয়নের সামনে। ব্যক্তি আইভীর চেয়ে তাঁর প্রতীককে লক্ষ্যবস্তু বানালে প্রচারে এগিয়ে থাকতে পারতেন তৈমুর।

এ ছাড়া ভোটের শুরু থেকেই আলোচনা ও প্রচারে ছিল, তৈমুর আলম সরকারদলীয় সাংসদ ও ‘গডফাদার’ খ্যাত শামীম ওসমানের প্রার্থী। বিষয়টি ভোটের শেষ দিন পর্যন্ত ছিল। কিন্তু এমন আলোচনার বিপরীতে নির্বাচনী প্রচারে তৈমুরকে সেভাবে অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। বরং এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য এবং ওসমান পরিবারের ব্যাপারে একধরনের নমনীয়তার ইঙ্গিত দিয়েছে।

সচেতন ভোটাররা মনে করেন, সেলিনা হায়াৎ আইভী নারায়ণগঞ্জে একটি প্রতিবাদী মুখ। এটিই তাঁর শক্তির অন্যতম প্রধান ভিত। তৈমুরের উচিত ছিল আইভীর জায়গাটি নিতে সরকার ও শামীম ওসমানদের অন্যায়, অরাজকতার বিষয়গুলো সামনে আনা। কিন্তু হয়েছে উল্টো। তৈমুর বরাবরই প্রধানমন্ত্রীর কৃপা চেয়েছেন, আর শামীম প্রসঙ্গে তুলনামূলক নীরব ছিলেন। উল্টো আওয়ামী লীগের বিভক্তির বিষয়টি সামনে এনে শামীম অনুসারীদের সহানুভূতি পেতে চেয়েছেন। এসব কারণে নারায়ণগঞ্জের সচেতন নাগরিকসহ ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষের বড় অংশটি তৈমুরের প্রতি আস্থা রাখতে পারেননি। তাঁরা আইভীবিরোধী তৎপরতায় শামীমদের ছায়া দেখেছেন।

বিষয়টি স্বীকার করে সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো শক্তিশালী দানবের বিরুদ্ধে লড়ছি। আমি নারায়ণগঞ্জকে শান্তির শহর বানাতে অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি।’

অবশ্য আইভীর জয়ের পেছনে তিনটি বিষয় কাজ করেছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক ধীমান সাহা। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এক. বিগত দিনের দৃশ্যমান উন্নয়ন, দুই. তাঁর সততা ও স্বচ্ছতা, তিন. শান্তিপূর্ণ নগরী গড়ার জন্য শুভ শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ নির্বাচন আইভীর জন্য যেমন কঠিন পরীক্ষার ছিল, তেমনি স্থানীয় রাজনীতির কর্তৃত্ব ধরে রাখতে তাঁর প্রতিপক্ষের জন্যও বড় পরীক্ষা ছিল। সব পরীক্ষায় উতরে গেছেন আইভী।