বরিশালের চারটি এলাকায় গবেষণা চালিয়েছে সিডিপি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সৃষ্ট বিপদে উপকূলের মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনৈতিক-সামাজিক সক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। খাবার, বাসস্থান, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের সংকটও প্রকট হচ্ছে।
সম্প্রতি এক গবেষণায় জলবায়ুজনিত দুর্যোগে উপকূলের মানুষের জীবনযাত্রার দুর্দশার চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, বরিশালের গ্রাম ও বস্তি এলাকার ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ নিয়মিত তিনবেলার খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেন না। একই সঙ্গে ৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় খাদ্য মজুত করতে অক্ষম এবং ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষের আয়বর্ধনমূলক কোনো প্রশিক্ষণ নেই।
জেলার সদর উপজেলার দুটি গ্রাম ও সিটি করপোরেশনের দুটি বস্তির প্রায় ৬ হাজার মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে এই তথ্য পেয়েছে কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ (সিডিপি) নামে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান। ব্রেড ফর দা ওয়ার্ল্ডের সহায়তায় ‘স্ট্রেন্থেনিং পিপলস অ্যাকশন অন ক্লাইমেট রিস্ক রিডাকশন অ্যান্ড এনার্জি ইফিসিয়েন্সি’ (স্পেস) নামে একটি প্রকল্পের আওতায় দেশের পাঁচ জেলায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির গবেষকেরা জানান, বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের সাতানী, নয়ানী, হিরণনগর বস্তি এবং নগরের আদি শ্মশানঘাট বস্তির সবগুলো খানায় এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। ২০২১ সালের মার্চে শুরু হয় এই জরিপের কাজ। চলতি বছরের মার্চে তা শেষ হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বরিশাল সদরের ওই ৪ এলাকার ১ হাজার ২৬৯টি খানার (গৃহ) ৫ হাজার ৭০৯ ব্যক্তির ঝুঁকি নিরূপণে জরিপ পরিচালনা করা হয়। এসব খানার মাসিক গড় আয় ১১ হাজার ৩৮০ টাকা। এর মধ্যে নয়ানী গ্রামের মানুষের গড় আয় সবচেয়ে বেশি, ১১ হাজার ৭০৩ টাকা। আদি শ্মশানঘাট বস্তির বাসিন্দাদের গড় আয় সবচেয়ে কম, ৯ হাজার ৫১৭ টাকা।
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, শিক্ষার দিক থেকেও এসব এলাকার বাসিন্দারা যথেষ্ট পিছিয়ে। ১৭ দশমিক ১ শতাংশ বাসিন্দা নিরক্ষর। স্বাক্ষর করতে পারেন এমন জনগোষ্ঠীর হার ১৯ দশমিক ৪। এর মধ্যে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ খানা প্রধানের পেশা দিনমজুরি। তাদের মধ্যে আবার ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ ভূমিহীন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই জনগোষ্ঠী যথেষ্ট বিপদাপন্ন।
জার্মান ওয়াচের প্রকাশ করা গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০২১ অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিপদাপন্ন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম। ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা বাংলাদেশকে জলবায়ুজনিত বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে এবং পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকির দেশে পরিণত করেছে।
বরিশালে দুটি গ্রাম ও দুটি বস্তির বিপদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নদীভাঙন, অসময়ে বন্যা, বজ্রপাত, অতিবৃষ্টি, তাপপ্রবাহ এবং শৈত্যপ্রবাহের মতো দুর্যোগ প্রতিবছর এসব এলাকার বাসিন্দাদের ভোগাচ্ছে। প্রতি দুই বছরে একবার জলাবদ্ধতা, খরা, শিলাবৃষ্টি এবং টর্নেডোর মতো দুর্যোগে আক্রান্ত হন তাঁরা। এসব বিপদের কারণে ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ খানা উচ্চমাত্রায় এবং ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ খানা মাঝারিমাত্রায় উন্মুক্ত।
গবেষণায় ভবিষ্যৎ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ খানার যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হবে, ৯৭ দশমিক ৬ শতাংশ খানার স্বাস্থ্যহানি, ৯২ শতাংশ খানার নিরাপদ পানি প্রাপ্তিতে এবং ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ খানার জীবিকার উৎস হারানোর আশঙ্কা আছে।
পূর্বাভাসে আরও বলা হয়েছে, ওই চার এলাকায় নদীভাঙনের ফলে ৭১ দশমিক ৯ শতাংশ খানা নদীতে বিলীন হতে পারে।
স্পেস প্রকল্পের বরিশাল অঞ্চলের এরিয়া কো-অর্ডিনেটর এ জেড এম রাশেদ বলেন, এসব স্থানের ঝুঁকি হ্রাস করতে ৭টি প্রস্তাবনা আছে। এর মধ্যে আছে কারিগরি শিক্ষার প্রসার, আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ, স্বল্প বা বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা, নদীভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণ, বিনা সুদে দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে গৃহঋণ ও আদি শ্মশানঘাট বস্তিতে স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।