তাক লাগানো গণিতপ্রতিভা শিশু জারিফ

‘আঙ্কেল, আপনার বয়স কত? জন্মতারিখ কত?’ বড় কাউকে দেখলেই এমন প্রশ্ন। জন্মসাল আর জন্মতারিখ বললে মুহূর্তেই মাস-দিনসহ বয়স বলে দেয় শিশুটি। যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ—সব যেন তার মস্তিষ্কে খেলা করে। অঙ্ক নিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেই হুটহাট উত্তর মেলে তার কাছে।

শিশুটির নাম জারিফ ইকবাল ওরফে ওয়ালীদ। বয়স মাত্র ছয় বছর। বাংলা, ইংরেজিসহ সব বিষয়ই সহজে শিখে ফেলে সে। তবে গণিতের মতো কঠিন বিষয়ে বিরল প্রতিভার জন্য স্থানীয় লোকজন শিশুটিকে ‘খুদে গণিতবিদ’ বলে ডাকে। তার সঙ্গে কথা বলতে ভিড় করে উৎসুক মানুষ।

জারিফ পাবনার ফরিদপুর উপজেলার বনওয়ারীনগর ইউনিয়নের সোনাহারা গ্রামের জাফর ইকবাল ও আক্তার বেগম দম্পতির দ্বিতীয় ছেলে। বনওয়ারী নগর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র সে।

ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানান, প্রথম শ্রেণিতে শিশুদের ১ থেকে ৫০ পর্যন্ত সংখ্যা চেনানো হয়। পঞ্চাশের ঘরের যোগ-বিয়োগ শেখানো হয়। বড় সংখ্যা থেকে ছোট সংখ্যা, ছোট সংখ্যা থেকে বড় সাজানো এবং সাধারণ যোগ-বিয়োগের মধ্যেই গণিতশিক্ষা সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু জারিফ বয়সের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। যোগ-বিয়োগ ছাড়িয়ে গুণন-ভাগ সবই আয়ত্তে নিয়েছে। ক্যালকুলেটরের সহযোগিতা ছাড়াই শুধু মেধা দিয়ে সে যেকোনো সংখ্যার যোগ-বিয়োগ, গুণন-ভাগ মুহূর্তের মধ্যে করে দিতে পারছে। বিস্ময় সৃষ্টি করেছে জন্মসাল ও জন্মতারিখ শুনে সঙ্গে সঙ্গে দিন, মাস, বছরসহ বয়স বলে দিয়ে।

বনওয়ারী নগর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এস এম আবদুর রব জানান, শিশুটি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। খুব চঞ্চল প্রকৃতির। প্রখর ধীশক্তির কারণে মুহূর্তেই সব আয়ত্ত করে ফেলে। ফলে শ্রেণিকক্ষে স্থির থাকতে পারে না। সারাক্ষণ ছোটাছুটি করে। তিনি বলেন, ‘জারিফের মধ্যে গণিতের অসাধারণ প্রতিভা রয়েছে। পরিচর্যা পেলে সে গণিতশাস্ত্রে বেশ ভালো করতে পারবে বলে আমরা আশা করছি। তাই শিশুটির প্রতি বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে।’

বিস্ময়শিশু জারিফ ইকবাল ওরফে ওয়ালীদ। ছবি: হাসান মাহমুদ

ছেলের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির জন্য গ্রাম ছেড়ে পাবনা শহরের বাড়িতে এসে উঠেছেন মা-বাবা। গত ২৪ নভেম্বর দুপুরে জারিফদের নতুন বাসস্থানে গিয়ে দেখা যায়, ঘর গোছানোর কাজ চলছে। আর নিজের ঘরে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে শিশু জারিফ। মাঝেমধ্যে বসছে পড়ার টেবিলে। বই-খাতা সব আধা ছেঁড়া। দেখেই মনে হচ্ছে এগুলো আর দরকার নেই তার।

বাড়ি থেকে জারিফকে নিয়ে বাইরে বেরোতেই চোখে পড়ে তাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ। তাকে পেলেই ঘিরে ধরে জন্মসাল, জন্মতারিখ বলে নিজের সঠিক বয়স শুনে নেয় লোকজন। কেউ কেউ দূর থেকে ‘খুদে গণিতবিদ’ বলে ডাকছে। স্থানীয় বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে দিয়ে জারিফকে বিভিন্ন সংখ্যার যোগ-বিয়োগ, গুণন-ভাগ ও জন্মতারিখ বিষয়ে পঞ্চাশের অধিক প্রশ্ন করানো হয়। মুহূর্তের মধ্যে প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করে জারিফ।

প্রশ্ন-উত্তর পর্ব শেষে ফরিদপুর পৌর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন প্রতিভা আগে কখনো দেখিনি। সত্যিই জারিফ বিস্ময়শিশু। সে দেশের সম্পদ। সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুটিকে বড় করা হলে সে দেশের বড় অর্জন হবে।’

বনওয়ারীনগর সিবি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী ঈশিতা আক্তার বলে, ‘প্রশ্ন করে আমি নিজেই হতভম্ব। এত ওপরের ক্লাসে পড়েও আমার পক্ষের তার মতো বলা সম্ভব নয়। অনেক বড় কেউও মুখে মুখে এমন যোগ-বিয়োগ, গুণন-ভাগ করতে পারে বলে আমার জানা নেই।’

বাবা জাফর ইকবাল ও মা আক্তার বেগমের সঙ্গে জারিফ ইকবাল ওরফে ওয়ালীদ। ছবি: হাসান মাহমুদ

জারিফের মা আক্তারী বেগম জানান, মুখে কথা ফোটার পর থেকেই জারিফ একটু আলাদা। চার বছর বয়সে প্রথম তাকে কিছু অক্ষর শেখার বই দেওয়া হয়। সে এক দিনেই বইগুলো মুখস্থ করে ছিঁড়ে ফেলে। সাড়ে চার বছর বয়সে অঙ্ক শেখাতে গিয়ে ৫০ পর্যন্ত পড়তে বলা হয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ১০০ পর্যন্ত বলতে শুরু করে।’

বাবা জাফর ইকবাল জানান, পাঁচ বছর বয়সে জারিফকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে গেলে হারিয়ে যেত। খুঁজে দেখা যেত, সে লোকজনকে ডেকে বয়স জানতে চাচ্ছে। প্রশ্ন করছে, ‘আঙ্কেল, আপনার বয়স কত? অথবা আপনার জন্মতারিখ কত?’ কেউ বয়স বললে জন্মসাল আবার জন্মসাল বললে বয়স বলে দিত। এখনো তার এই অভ্যাসটা রয়ে গেছে। কাউকে পেলেই বয়স বের করে দিচ্ছে। এটা এখন তার খেলায় পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, কখনো জারিফকে পড়ালেখার বিষয়ে কিছু বলতে হয় না। সে নিজে থেকেই সব আয়ত্ত করে।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম মোসলেম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি জারিফকে দেখেছি, কথা বলেছি। সে জন্মতারিখ বের করাসহ গণিত নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমাকে অবাক করেছে। সত্যিই এটা বিস্ময়কর। ভবিষ্যতে শিশুটি দেশের বড় গণিতবিদ হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।’