বাংলাদেশের ওপর লতিফুর রহমানের বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছিল শতভাগ। অন্য অনেকের মতো বিদেশে বিনিয়োগ ও নিবাস না গড়ে তিনি সবকিছু বাংলাদেশে করেছেন। এই নীতি মেনে সবাই যদি দেশে বিনিয়োগ করেন, দেশেই সম্পদ গড়েন, তাহলে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে।
এ বক্তব্য উঠে আসে ট্রান্সকম গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের স্মরণে আয়োজিত এক আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলে। লতিফুর রহমানের চেহলাম উপলক্ষে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি)-বাংলাদেশ দেশের ১৩টি বাণিজ্য সংগঠনকে নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ভার্চ্যুয়ালি এই স্মরণসভার আয়োজন করে।
লতিফুর রহমান গত ১ জুলাই কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাতবারের সভাপতি, আইসিসি বাংলাদেশের সহসভাপতি ও আইসিসির পর্ষদ সদস্য।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান। তিনি লতিফুর রহমানের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বলেন, ‘তাঁর (লতিফুর রহমান) মৃত্যুতে আমি ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।’
লতিফুর রহমানের পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর নাতি যারেফ আয়াত হোসেন অনুষ্ঠানে বলেন, ‘লতিফুর রহমানের প্রয়াণের পর দেশের ব্যবসায়ী সমাজ যেভাবে তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যেভাবে তাঁকে সম্মান জানিয়েছেন, তাতে আমরা খুবই কৃতজ্ঞ। এটা আমাদের শোক কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়।’
বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, লতিফুর রহমান ছিলেন এক বিরাট ব্যক্তিত্ব। মানুষের সঙ্গে আচার-ব্যবহারের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন খুবই সরল।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ‘দেশের বেসরকারি খাতের ভিত্তি তৈরি করেছেন লতিফুর রহমানের মতো ব্যবসায়ীরা। নতুন প্রজন্ম তার সুফল পাচ্ছে।’
শামস মাহমুদ করোনাকালে প্রয়াত সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নিলুফার মঞ্জুর (সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর স্ত্রী) ও লিন্ডে বাংলাদেশের প্রয়াত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়ালিউর রহমান ভূঁইয়ার মৃত্যুতে ঢাকা চেম্বারের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করেন।
এমসিসিআইয়ের সহসভাপতি আনিস এ খান জানান, সংগঠনটির গুলশান কার্যালয়ের একটি লাউঞ্জের নামকরণ করা হয়েছে লতিফুর রহমানের নামে।
অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, লতিফুর রহমান দেখিয়েছেন সৎভাবে ব্যবসা করেও সফল হওয়া যায়। তরুণেরা লতিফুর রহমানকে অনুসরণ করতে পারে, তাহলে লতিফুর রহমানের মতো ব্যবসায়ীর যে বিরাট শূন্যতা, তা পূরণ হবে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘লতিফুর রহমান নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর মতো সৎভাবে ব্যবসা করতে পারলে নিজেকে গর্বিত মনে করব।’
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি রূপালী চৌধুরী বলেন, এ দেশে কেউ সৎ পথে চললে তাঁকে দুর্বল মনে করা হয়। লতিফুর রহমানের ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল ভিন্ন। তিনি সততাকে পথ হিসেবেই বেছে নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি রুবানা হক বলেন, জীবনের বিয়োগান্ত ঘটনাকে শক্তিতে পরিণত করার বিরল ক্ষমতা ছিল লতিফুর রহমানের।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘লতিফুর রহমান নিজেই একটি ব্র্যান্ড। তাঁকে নিয়ে কখনো কাউকে সমালোচনা করতে দেখিনি।’
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল মুক্তাদির উল্লেখ করেন যে লতিফুর রহমান অসম্ভব সুন্দর প্রতিষ্ঠান রেখে গেছেন, যার মান ও নৈতিক মূল্যবোধ অত্যন্ত উঁচু।
আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, সততা ও নৈতিকতা নিয়ে সফলতার একটি প্রতীক লতিফুর রহমান।
নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, লতিফুর রহমানের মতো মানুষকে দেখে তাঁদের মতো হওয়ার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।
আইসিই টেকনোলজিস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মাহবুব জামিল বলেন, বিশাল ব্যবসা সাম্রাজ্যের কর্ণধার হওয়ার পরও লতিফুর রহমান ছিলেন অমায়িক ও অসম্ভব বিনয়ী।
দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, লতিফুর রহমানের মতো মানুষের শত্রু থাকার কথা নয়। সেটা হয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত দুই পত্রিকায় স্বাধীন লেখালেখির কারণে। কিন্তু তিনি সেটা কখনো বুঝতে দেননি। তিনি বলেন, ‘আমি খুব গর্ব করে বলি যে আমি ও মতিউর রহমান (প্রথম আলো সম্পাদক) পৃথিবীর দুজন স্বাধীনতম সম্পাদক। এই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি বোর্ডের কাছ থেকে, লতিফুর রহমানের কাছ থেকে। সেটা আমি প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করি।’
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ছাত্রজীবনে আমাদের স্বপ্ন ছিল সুন্দর, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও সফল বাংলাদেশ গড়ব। সে জন্য আমরা সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। আমাদের স্বপ্ন ছিল দেশকে গড়তে স্বাধীন সাংবাদিকতা করব, প্রগতিশীল পত্রিকা প্রকাশ করব।’
প্রথম আলো প্রকাশের আগে ২৮ বছরের সাংবাদিকতা জীবনের কথা উল্লেখ করে মতিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল প্রথম আলোতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে। স্বপ্ন পূরণে তিনি (লতিফুর রহমান) সত্যিকারের সহযোগী ছিলেন, বন্ধু ছিলেন, অনুপ্রেরণা ছিলেন। এ কারণে তাঁকে নানা ঝামেলা ও বিপদে পড়তে হয়েছে। তবু তিনি মেনে নিয়েছেন। মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি বিজয়ী হয়েছেন, সফল হয়েছেন, সর্বমহলে স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছেন।’
ব্যাংকমালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস বাংলাদেশের (এবিবি) সদস্যসচিব এ কে এম নুরুল ফজল বুলবুল বলেন, লতিফুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের একজন মহান সন্তান।
নরডিক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এনসিসিআই) সভাপতি তারেক রহমান বলেন, লতিফুর রহমান থাকলে এখন উত্তরণের পথ দেখাতে পারতেন।
আইসিসি বাংলাদেশের সহসভাপতি রোকিয়া আফজাল রহমান বলেন, ‘শামীম ভাই (লতিফুর রহমান) নেই, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। সব সময় মনে হয় তিনি আমাদের পাশেই রয়েছেন।’
অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করেন খতিব মাওলানা মুফতি মাসুম। পরে তিনিই দোয়া-মাহফিল পরিচালনা করেন। অনুষ্ঠানে নির্ধারিত বক্তাদের বাইরে অনেকেই যোগ দেন।