গত বছরের মার্চের শেষের দিকের কথা। তখন দেশে অতিমারি করোনাভাইরাসের কারণে চলছে কঠোর লকডাউন। ঘর থেকে বের হওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তখন। এর মধ্যে ২৭ মার্চ রাত আটটার দিকে চট্টগ্রাম শহরের মিয়া খান নগর এলাকা থেকে তরুণ আইনজীবী এস এম ওয়াহিদের মুঠোফোনে এল সহায়তার আবেদন। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ১০ বছরের এক শিশুর জন্য বি পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন। ওয়াহিদের রক্তের গ্রুপও বি পজিটিভ। পরদিন ২৮ মার্চ সকাল ১০টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে হাজির হন তিনি। রক্ত দেন ওই শিশুকে। ৩৩ বছরের ওয়াহিদ ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনি ৪৩ বার রক্ত দিয়েছেন। মানুষের সঙ্গে রক্তেই যেন গড়েছেন অনন্য এক বন্ধন।
শুধু ওয়াহিদ নন মাঈনুদ্দিন হাসান, রাশেদুল ইসলাম, মেহেরুল হাসান, অনীক ধর, জুনায়েদ সালেহসহ বেশ কয়েকজন তরুণ কারও রক্তের প্রয়োজন পড়লেই ঝাঁপিয়ে পড়েন। রক্ত দিয়েই তাঁরা দায়িত্ব শেষ করেন না, বরং অন্যকেও রক্ত দিতে উৎসাহিত করেন। খুঁজে দেন দুষ্প্রাপ্য গ্রুপের রক্তও। এ জন্য ২০১৬ সালে তাঁরা গড়ে তোলেন ফেসবুকভিত্তিক স্বেচ্ছায় রক্তদানের সংগঠন। নাম দোহাজারী ব্লাড ব্যাংক। উদ্যোক্তা, অ্যাডমিনদের সবার বাড়ি চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী হওয়ায় সংগঠনটির এমন নামকরণ। বর্তমানে ফেসবুকভিত্তিক এই পাবলিক গ্রুপের সদস্যসংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। প্রতিদিন গড়ে ৬ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করেন তাঁরা বিনা মূল্যে। এ পর্যন্ত তাঁরা প্রায় ৮ হাজার বিভিন্ন রোগীকে ৯ হাজার ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন।
বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও দোহাজারী ব্লাড ব্যাংকের অ্যাডমিন মাঈনুদ্দিন হাসান বলেন, শুধু করোনাকালের এক বছরে তাঁরা প্রায় এক হাজার বিভিন্ন রোগীকে এক হাজার ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন।
কী করে এমন সংগঠন গড়ে তোলা সম্ভব হলো, জানতে চাইলে মাঈনুদ্দিন হাসান বলেন, ২০১৬ সালের ২৬ জুন দোহাজারী ব্লাড ব্যাংক নাম দিয়ে ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল সহজে রক্তের সন্ধান দেওয়া। ওই দিনই এই পোস্ট দেখেই নয়ন নাথ নামের চট্টগ্রামের এক সোনার দোকানের এক কর্মচারী যুক্ত হন গ্রুপে। এরপর একে একে তাঁর সহপাঠী রাশেদুল ইসলাম, মেহেরুল হাসান ও এস এম ওয়াহিদ। তাঁরা পাঁচজনে মিলে সাধারণ সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন। এতে নতুন নতুন রক্তদাতা জোগাড় হতে থাকে।
বর্তমানে ফেসবুকে দোহাজারী ব্লাড ব্যাংক সংগঠনের পাবলিক গ্রুপের আটজন অ্যাডমিন রয়েছে। তাঁদের মধ্যে মাঈনুদ্দিন হাসান প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন। এ ছাড়া সহ–কার্যকরী ৫০ জন ও ১১ জন মডারেটের রয়েছেন। রক্তদাতাদের মধ্যে সুপার ডোনার রয়েছেন ১০ জন। তাঁরা রক্ত দেওয়ার জন্য দেশের যেকোনো প্রান্তে যেতে প্রস্তুত। তাঁরা চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকা, ফেনী, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলাসহ বিভিন্ন জেলায় গিয়েও রক্ত দেন।
রক্তদান ছাড়াও এলাকায় তাঁরা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালান। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মহাসড়কের গতিরোধক স্থাপন, শীতবস্ত্র বিতরণ, ব্লাড গ্রুপিং ও থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করেন। সংগঠনটি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে এ পর্যন্ত ৪০টির বেশি সম্মাননা পেয়েছে। অ্যাডমিন এস এম ওয়াহিদ ফেনী ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকে সর্বোচ্চ রক্তদাতার সম্মাননা পেয়েছেন।
সাতকানিয়া উপজেলার থ্যালাসেমিয়া রোগী মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলামের (১১) বাবা আবদুর রহিম বলেন, এক বছর ধরে তাঁর ছেলেকে প্রতি মাসে দুবার করে রক্ত দিতে হচ্ছে। করোনারকালে যেখানে মানুষ ভয়ে ঘর থেকে বের হতে চায়নি, সেখানে দোহাজারী ব্লাড ব্যাংকের সদস্যরা প্রতি মাসে দুবার করে এসে রক্ত দিচ্ছেন। তাঁদের ঋণ কখনো শোধ করতে পারবেন না বলে জানান আবদুর রহিম।
সংগঠনের আরেক অ্যাডমিন জুনায়েদ সালেহ বলেন, গত ২০১৮ সালের দিকে কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার আল-নুর হাসপাতালে একজন ১২ বছরের শিশুকন্যা রক্তশূন্যতায় ভুগছিল। ওই শিশুর রক্তের গ্রুপ হচ্ছে এবি নেগেটিভ। তাই কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছিল না। ১২ দিন ধরে তার স্বজনেরা রক্তের সন্ধানে ছিলেন। অবশেষে বিষয়টি জানতে পেরে তাঁদের এক সদস্য তৌহিদুল ইসলাম রক্ত দেন। এতে বেঁচে যায় শিশুটি।
চন্দনাইশ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার চৌধুরী বলেন, রক্তদানসহ দোহাজারী ব্লাড ব্যাংকের মানবিক কার্যক্রম এলাকায় দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। মানবতার কল্যাণে তরুণেরা কীভাবে এগিয়ে আসতে পারে, তা তাঁরা দেখিয়েছেন।