আরও একটি খুলিসহ কঙ্কাল ও হাড় উদ্ধার

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পুড়ে যাওয়া হাসেম ফুড কারখানার চারতলায় ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় বৃহস্পতিবার দিনভর তল্লাশি চালিয়ে মাথার খুলিসহ কঙ্কাল ও হাড় উদ্ধার করেছে সিআইডি
প্রথম আলো

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড কারখানায় আগুন লাগার দুই মাস পর তল্লাশি চালিয়ে আরও একজনের মাথার খুলিসহ পুরো কঙ্কাল ও হাড়ের কিছু অংশ উদ্ধার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পুড়ে যাওয়া ওই ভবনের চারতলায় সিআইডির নেতৃত্বে ফায়ার সার্ভিস ও থানা-পুলিশের সহায়তায় সেখানে তল্লাশি অভিযান চালানো হয়।

এর আগে গত মঙ্গলবার অভিযান চালিয়ে ওই ভবনের চারতলা থেকে দুটি মাথার খুলি ও হাড়ের অংশ এবং নারীর মাথার চুল উদ্ধার করেছিল সিআইডি।

গত ৮ জুলাই হাসেম ফুড কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫১ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে আগুনে পুড়ে ৪৮ জন ও লাফিয়ে পড়ে ৩ জন মারা যান। ডিএনএ পরীক্ষা শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ৪৫ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সিআইডি নারায়ণগঞ্জ অফিসের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হারুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, দ্বিতীয় দফায় ওই ভবনের চারতলায় তল্লাশি চালিয়ে মাথার খুলিসহ পুরো শরীরের কঙ্কাল ও হাঁটুর নিচের অংশের হাড় উদ্ধার করা হয়েছে। যেখান থেকে কঙ্কাল ও হাড় উদ্ধার করা হয়েছে, সেখানে নারীদের পোশাক বদলানোর রুম এবং উৎপাদিত মালামাল মজুত করে রাখা হতো। ধারণা করা হচ্ছে, আগুন লাগলে ওই জায়গায় গিয়ে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেই তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।

সিআইডির কর্মকর্তা আরও বলেন, তিনজনের পরিবারের লিখিত বক্তব্য আমলে নিয়ে সেখানে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। পরিবারের সদস্য দাবি করা ব্যক্তিদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে উদ্ধার হওয়া হাড়ের নমুনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পুড়ে যাওয়া হাসেম ফুড কারখানায় ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় বৃহস্পতিবার চারতলায় দিনভর তল্লাশি চালায় সিআইডি

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, স্বজনদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফায়ার সার্ভিসকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় কারখানায় তল্লাশি চালিয়ে বর্জ্যের ভেতর থেকে মাথার খুলিসহ কঙ্কাল ও হাড় উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে তল্লাশি অভিযান অব্যাহত থাকবে।

এ বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওই কারখানার বিভিন্ন তলায় প্লাস্টিক ছিল। সেগুলো গলে সিমেন্টের মতো জমে শক্ত হয়ে গিয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস যখন উদ্ধার অভিযান চালিয়েছিল, তখন তারা হয়তো সেগুলো উদ্ধার করতে পারেনি।

ঘটনার দুই মাসেও অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি

৮ জুলাই হাসেম ফুড কারখানায় আগুনে পুড়ে ৪৮ জনসহ মোট ৫১ জনের মৃত্যু হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ৪৮ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে কারখানার মালিক আবুল হাসেম, তাঁর চার ছেলেসহ আটজনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে পৃথক আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষা শেষে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৫ জনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সবশেষ পাওয়া তিনজনের লাশ ডিএনএ পরীক্ষায় শনাক্ত হওয়ার পর হস্তান্তর করবে সিআইডি।

এর আগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তদন্তে উঠে আসে, অতিরিক্ত তাপে কারখানার নিচতলার একটি এগজস্ট ফ্যানের তার গলে আগুনের সূত্রপাত হয়। সেখানে অনেক দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ওই কারখানায় অগ্নিপ্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এ কারণে প্রাণহানি বেশি হয়েছে।

এদিকে ৫ আগস্ট জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি তদন্তে হাসেম ফুড কারখানায় আগুনে পুড়ে ৫১ জনের মৃত্যুর ঘটনায় কারখানার মালিক কর্তৃপক্ষ, সরকারি দুটি সংস্থা শ্রম অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে গাফিলতির প্রমাণ পায়। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রম অধিদপ্তর এবং কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেনি। তারা ঠিকঠাকমতো দায়িত্ব নিয়ে মনিটরিং (তদারকি) করলে এ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি এড়ানো যেত। তদন্তে কারখানায় নানা ধরনের অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। এদিকে গ্রেপ্তার কারখানার মালিক আবুল হাসেম ও তাঁর চার ছেলে এবং কারখানার তিন কর্মকর্তা বর্তমানে জামিনে মুক্ত। সিআইডি কারখানার মালিক আবুল হাসেম, তাঁর দুই ছেলে এবং কারখানার তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

এ ছাড়া ১৭ আগস্ট সিআইডি নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপমহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া, পরিদর্শক নেছার আহমেদ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স নারায়ণগঞ্জ অফিসের (সোনারগাঁ ও রূপগঞ্জ অঞ্চল) উপসহকারী পরিচালক তানহারুল ইসলামকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁদের বক্তব্যে হাসেম ফুড কারখানার অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, গাফিলতি ফুটে উঠেছে। তবে অনেক প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি সরকারি সংস্থা দুটির কর্মকর্তারা।