বিদেশি পণ্য বর্জন ও স্বদেশি পণ্য ব্যবহার করার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের সলঙ্গা হাটে গণহত্যা সংঘটিত হয়। যুবনেতা মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে সলঙ্গা এলাকায় আন্দোলনরত জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে ব্রিটিশ পুলিশ। নিহত হন কয়েক শ মানুষ।
সেদিনের ঘটনার লিখিত দলিল খুব বেশি মেলে না। তবে তৎকালে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা একটি খাতায় লিখে রাখতেন। পরিবারের কাছে থেকে পাওয়া সেই খাতার লেখা সমন্বয় করে ২০০৩ সালে মাওলানা তর্কবাগীশ পাঠাগারের যুগপূর্তির স্মরণিকায় একটি লেখা প্রকাশ করা হয়। আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নামে প্রকাশিত লেখাটির শিরোনাম ‘স্বাধীনতাসংগ্রামের রক্ত সিঁড়ি সলঙ্গা’। তর্কবাগীশ মারা যান ১৯৮৬ সালে।
নিজের লেখায় আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ উল্লেখ করেন, তখন (১৯২২) দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলনের জোয়ার। প্রতিটি শহরে, গ্রামগঞ্জে, হাটবাজারে বিদেশি বস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্য বয়কট করার জন্য স্বেচ্ছাসেবকেরা দলে দলে অভিযান চালাচ্ছেন। সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারও তার দমননীতি আরও কঠোর করে। জানুয়ারি মাসে বগুড়া ও পাবনার সীমান্তের চান্দাইকোনায় মঙ্গলবারের সাপ্তাহিক হাটে স্বেচ্ছাসেবকদের পণ্য বয়কট অভিযানে কয়েকজন পুলিশ বাধা দেয়। এতে জনগণ উত্তেজিত হয়ে পুলিশের হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে হাটসংলগ্ন ফুলজোড় নদীতে ফেলে দেয়। এ ঘটনায় পুলিশ এই এলাকায় কংগ্রেস কর্মী ও জনসাধারণের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে পড়ে এবং সুযোগ খুঁজতে থাকে। একদিন সে সুযোগ করে নেয় এবং পরিকল্পিতভাবে সলঙ্গা হাটে স্বেচ্ছাসেবক ও নিরীহ জনসাধারণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তর্কবাগীশ লিখেছেন, কংগ্রেস অফিস থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে হাটের দক্ষিণ প্রান্তে নিয়ে যায়। মারমুখী জনতাকে শায়েস্তা করতে পুলিশ সুপার হুকুম করেন, ‘ফায়ার।’ সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে ৩৯টি রাইফেল। গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর সামনেই সাতজন নিহত হন। সরকারি তদন্ত রিপোর্টে তখন হতাহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
উত্তেজিত জনতা হলঙ্গা, ফালা, লাঠি, সড়কি, বল্লম নিয়ে চারদিক থেকে এগিয়ে আসে। স্মরণিকার লেখা অনুযায়ী আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ জনতাকে বলেছিলেন, ‘এখন আপনারা যদি নিরস্ত্র না হন, শান্ত না হন, তবে এ সংবাদ পেয়ে আরও পুলিশ আসবে, গোরা সৈন্যও আসবে। তারা এলে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে, নির্বিচারে হত্যা করবে, ধরে নিয়ে যাবে।’
তর্কবাগীশ লেখেন, ‘তদন্তকারীদের কাছে সবই বলেছিলাম। পরে জানতে পারি, সরকার উল্টো ঘাতকদের পদোন্নতি ও পুরস্কৃত করেছে।’
তর্কবাগীশ তাঁর লেখায় ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদাহরণও টেনেছেন। লিখেছেন, ‘জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের হোতা ও’ডায়ারকে কোনো শাস্তি না দিয়ে লন্ডনে জৌলুশ জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। অনেক পরে হলেও (১৯৪০) লন্ডনের বুকে পাঞ্জাবের এক শিখ সন্তান উধম সিং ও’ডায়ারকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেন।’ প্রসঙ্গত, উধম সিংয়ের সে ঘটনা নিয়ে ২০২১ সালে ভারতে মুক্তি পেয়েছে সরদার উধম নামে চলচ্চিত্র।