লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড

তদন্ত কমিটির কাছে ঘটনার বর্ণনা দিলেন বেঁচে ফেরা ২২ যাত্রী

লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত বক্তব্য দেন। সার্কিট হাউস, বরগুনা, ২৬ ডিসেম্বর
ছবি: সাইয়ান

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান–১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য নিয়েছে। আজ রোববার বরগুনা সার্কিট হাউসের সম্মেলনকক্ষে লঞ্চ থেকে বেঁচে ফেরা ২২ জন যাত্রী সেদিনের ঘটনার লিখিত ও মৌখিক বর্ণনা দেন। দুপুর ১২টা থেকে শুরু হয়ে বেলা ২টা পর্যন্ত চলে সাক্ষাৎকার গ্রহণ।

প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রীদের বক্তব্য শোনেন তদন্ত দলের আহ্বায়ক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বন্দর) মো. তোফায়েল ইসলাম, তদন্ত দলের সদস্য বরিশাল অঞ্চলের নৌ পুলিশ সুপার মো. কফিল উদ্দিন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল সংস্থার পরিচালক মামুন-অর-রশিদ, তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত পরিচালক (বন্দর) মো. সাইফুল ইসলাম, সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ ও বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান।

বেতাগী পৌরসভার বাসিন্দা মো. সাহেব আলী লিখিত বর্ণনায় বলেন, রাত তিনটার সময় লঞ্চের ভেতর ‘আগুন, আগুন’ শব্দে তিনি ঘুম থেকে উঠে দেখেন, পেছনের একটা স্থান দিয়ে আগুন ওপরে উঠে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে যে পাশে আগুন নেই, সেই পাশে গিয়ে দাঁড়ান। তখন নদীতে কিছু লোকে সাঁতার কাটতে দেখেন এবং চারপাশে মানুষের আহাজারি শোনেন। তিনি পর্দার রশি ধরে নিচে নেমে দাড়ান এবং কিনারা কোথায়, তা দেখার চেষ্টা করেন। এমন সময় নদীর তীরে মানুষের লাইটের আলো দেখতে পান। তিনি নদীতে ঝাঁপ দেন। সে সময় আরও কয়েকজনকে ঝাঁপ দেওয়ার শব্দ শুনতে পান। অনেক সময় নদীতে সাঁতার কাটার পর কিনারায় পৌঁছান তিনি। লঞ্চটির ইঞ্জিনের সমস্যার কারণে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বলে লিখিত জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেন।

বরগুনার হাইস্কুল সড়কের বাসিন্দা মো. সানাউল্লাহ তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন, তিনি লঞ্চটির কেবিনে ছিলেন। লঞ্চ ছাড়ার পরপরই একজন চালক মুঠোফোনে বলছিল, ‘স্যার, ইঞ্জিন ৪০০ পাওয়ারে চলে।’ চাঁদপুর থেকে অনেক যাত্রী উঠেছেন। সব মিলিয়ে দুই হাজারের মতো যাত্রী ছিলেন লঞ্চে। লঞ্চটি চলা অবস্থায় অস্বাভাবিক শব্দ করছিল। এ সময় কয়েকজন যাত্রী চালকের কাছে জানতে চান, ইঞ্জিনে এমন শব্দ কেন! চালক বলছিলেন, কোনো সমস্যা নেই, ইঞ্জিনে কাজ করানো হয়েছে। একজন ইঞ্জিনিয়ার সঙ্গে আছে। এরপর ঘুমিয়ে পড়েন সানাউল্লাহ। রাত তিনটার দিকে লোকজনের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। উঠে দেখেন, মানুষ ছোটাছুটি করছে। ইঞ্জিনরুম থেকেই আগুন লাগার ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি।

সাদিকুর রহমান নামের বাঁশবুনিয়া গ্রামের এক বাসিন্দা ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছেলেন। তদন্ত কমিটিকে তিনি বলেন, বড় লঞ্চ কম শক্তির ইঞ্জিন দিয়ে চালানোর কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। একই সঙ্গে দুটি লঞ্চ চলাচলা করায় কে কার আগে গন্তব্যে পৌঁছাবে, তার প্রতিযোগিতায় বেপরোয়া গতিতে লঞ্চ চলানো হয়। এসব কারণেও লঞ্চে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন এই যাত্রী।

অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া এমভি অভিযান–১০ লঞ্চের বারান্দা

পাথরঘাটা রহমানিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সঞ্জিব চন্দ্র হাওলাদার বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে লঞ্চের বারান্দায় বসা ছিলেন তিনি। লঞ্চে বিকট শব্দ হলে তিনি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেন—আগুনের লেলিহান শিখা তাঁর দিকে দ্রুতগতিতে আসছে। মুহূর্তের মধ্যেই আগুন পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে পরে। ধোঁয়ায় আর কিছু দেখা যায় না, তিনি পর্দার কাপড় খোলার চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেননি। পরে জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দেন। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় সাঁতার কাটার পর তিনি তীরে ওঠেন।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষে তদন্ত দলের সদস্যসচিব বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত পরিচালক (বন্দর) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘লঞ্চে যারা যাত্রী ছিল, যারা আহত ও প্রত্যক্ষদশী, তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। আমরা বরগুনায় ২২ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। এখন বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করব।’ তিনি বলেন, এর আগে তাঁরা লঞ্চ পরিদর্শন করেছেন। এরপর টেকনেশিয়ান দিয়ে পরিদর্শন করাবেন এবং যে জায়গায়টা দিয়ে আগুনের উৎপত্তি বলা হচ্ছে, টেকনেশিয়ান দিয়ে সেটি পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হবে, তারপর কমিটি সবকিছু বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন।