ঢলে ভাসছে মানুষ ও তাদের সহায়সম্বল

তিন মাস আগে নিশ্চিহ্ন হয় দলিকার চর। সেই চরের ৩৫০ পরিবার আশ্রয় নেয় নতুন একটি চরে। সেই চরও তলিয়ে গেছে যমুনার ঢলে।

যমুনার পানি বেড়ে ডুবে গেছে বসতঘর। উঁচু স্থানে রান্না করার জন্য পাতিল নিয়ে যাচ্ছেন এক নারী। গতকাল বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার একটি চরে

চারদিকে যমুনা নদী। মাঝখানে দুর্গম চর। উত্তাল যমুনার যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। নদীর মাঝখানে অনেকটা দ্বীপের মতো উঁচু জায়গায় টিনের বেড়ার শ দুয়েক ঘর। ঘরের আঙিনায় যমুনার ঢলের স্রোত। ঘরের ভেতরে কোমরপানি। চাল রাখার ড্রাম, পুরোনো ট্যাংক আর সাংসারিক কিছু জিনিসপত্র উঁচু মাচায় রেখেছেন শাহজাহান শেখ। স্ত্রী-সন্তানদের রেখে এসেছেন যমুনার ওপারে জামালপুরের ইসলামপুরের একটি চরে। মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু ভেসে যাওয়ার উঠানে ডিঙি নৌকায় বসে উদ্‌ভ্রান্তের মতো এদিক–সেদিক তাকাচ্ছেন তিনি।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের বিলীন হওয়া দলিকার চরের শাহজাহান শেখের (৪০) এই দুর্গতির দৃশ্য গতকাল রোববার দুপুরের।

যমুনা গর্ভে তিন মাস আগেই বিলীন হয় দলিকার চর। বসতভিটা হারিয়ে সাড়ে তিন শ পরিবার সহায়সম্বল নিয়ে কোনোরকমে আশ্রয় গেড়েছিল পাশের ইসলামপুর উপজেলার কালিরচর সংলগ্ন নতুন একটি চরে। সেখানেও টিন–বেড়ার বসতঘরের অর্ধেক তলিয়েছে যমুনার ঢলে। অনেক পরিবার এখনো সেখানে বানের ঢলে ভাসছে। শাজাহান শেখের মতোই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন অনেকে।

শাহজাহান শেখ বলেন, ‘৪০ বছরত ২৪ বার বসতভিটা গিলচে যমুনা। গতবার বানত এক মাইল দূরে বসতভিটা আচলো। এক রাতেই সব শ্যাষ। পরে অন্যের জায়গাত ঘর তুলনু। তিন মাস আগত সেডাও যমুনার প্যাটত। রাতত খায়্যাদায়া ঘুমাচি, বিয়ানবেলা লদীর গর্জনে ঘুম ভাঙচে। কোনোরকমে লৌকাত উঠে এটি আসিচি। কপাল খারাপ। ছয় দিন থ্যাকে এটিও বানের ঢলত ভাসিচ্চি।’

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে যমুনার ওই নতুন চরের বসতঘরে দুর্ভোগ-কষ্ট এখন নিত্যকার ঘটনা। সারিয়াকান্দির কালিতলা খেয়াঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় প্রায় দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হয় এই চরে।

প্রবল স্রোতের বিপরীতে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যেতে যেতে চোখে পড়ে নদীর কিনারে সদ্য গড়ে ওঠা চরের লোকালয়। লোকালয়জুড়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর সুনসান নীরবতা। বেশ কয়েকটি ছোট্ট ডিঙি নৌকার দেখা মিলল সেখানে। বসতঘরগুলো কোমরসমান পানিতে তলিয়ে গেছে।

বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে যমুনা নদীবেষ্টিত ওই নতুন চরে বসবাস প্রায় তিন হাজার মানুষের। ৩৫০টি পরিবারের জীবিকা চলে যমুনায় মাছ ধরে। বসতঘর তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ আশ্রয় নিয়েছে নৌকায়, টিন–বেড়ার ঘরে বাঁশের উঁচু মাচা ফেলে। তলিয়ে গেছে নলকূপ। নদীর পানি খেয়ে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে মানুষ।

চরের বাসিন্দারা জানান, তিন মাস আগে মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয় দলিকার চর। এরপর ৩৫০টি ইসলামপুরের কালিরচর সংলগ্ন নতুন চরে আশ্রয় নেয়। যমুনার ঢলে বসতঘর তলিয়ে যাওয়ায় ১৫০ পরিবার ইতিমধ্যে চলে গেছে।

চরের বাসিন্দা আমির শেখ (৭০) বলেন, ‘এই বয়সে ১৯ বার বসতঘর টানচি, ২০ বার ভাঙচে। দলিকার চরত থন তিন মাস আগে এই চরত আসিচি। সেডাও এখন জলত ভাসিচ্চে।’

দলিকার চরের মাঝি ফজল শেখ (৫৫) বলেন, ‘দলিকার চরত প্রাইমারি ইশকুল, মসজিদ আচলো। সব শ্যাষ। এখন সগলি যাযাবর। মাথা গোঁজবার ঠাঁই নাই।’

চরের দিনমজুর আজহার শেখ (৬০) বলেন, ‘সাত দিন ধরে জলত ভাসিচ্চি। নৌকায় রাত কাটাচ্চি। চুলা জ্বলে না। ঘরত খাবার নেই। খুব কষ্টে আচি।’

পানিবন্দী ৪০ হাজার মানুষ

যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। রোববার সন্ধ্যা ৬টায় পানি বেড়ে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া পয়েন্টে যমুনায় বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে সারিয়াকান্দি উপজেলার চরাঞ্চলের চালুয়াবাড়ি, কাজলা, কর্নিবাড়ি, বোহাইল, হাটশেরপুর ইউনিয়নের ৮২টি চরসহ চন্দনবাইশা, কামালপুর, কুতুবপুর এবং সদর ইউনিয়নের দুর্গম চর এবং নদীতীরবর্তী মোট ৫২টি গ্রামের ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দী।

সারিয়াকান্দি চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, দলিকা, হাটবাড়ি, নোয়ারপাড়া চরের ৬০০ পরিবারের প্রায় ২ হাজার ৫০০ মানুষ গৃহহারা। পানিবন্দী অন্য চরের আরও কয়েক হাজার মানুষ।

সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাসেল মিয়া বলেন, ৫২টি গ্রামের ১০ হাজার পরিবারের ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। দুর্গম এলাকার পানিবন্দী মানুষের মধ্যে ৩০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। আরও ১০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দের চাহিদা পাঠানো হয়েছে।