বিদ্যুতের মূল্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) আইন অনুযায়ী, লাভে থাকলে কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করতে পারে না। ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে দুই বিতরণকারী সংস্থা ডিপিডিসি ও ডেসকো লাভে রয়েছে। তা সত্ত্বেও তারা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে।
আর ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) দেওয়া প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি করছে বিইআরসি।
বিদ্যুৎ খাত–সংশ্লিষ্টরা এবং আইনজীবীরা বলছেন, ডিপিডিসি ও ডেসকোর প্রস্তাবে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এই শুনানি বেআইনি।
পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে এসেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সংস্থাটি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে ১ টাকা ১১ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বিইআরসিতে। এ প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। পিডিবি পাইকারি ছাড়াও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিতরণ করে থাকে। পিডিবি ছাড়া দেশে আরও পাঁচটি বিতরণ সংস্থা রয়েছে। এগুলো হলো ডেসকো, ডিপিডিসি, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো) ও নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো)।
নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে পিডিবি পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়বে। সেই দামের সঙ্গে সমন্বয় করতে খুচরা গ্রাহক পর্যায়ের ছয়টি বিতরণ প্রতিষ্ঠান বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে। এবার পাইকারি ও গ্রাহক পর্যায়ের খুচরা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব একই সঙ্গে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে প্রতিটি বিতরণ সংস্থা দাম বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করেনি।
বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে আসে, তাদের ভবিষ্যতে আয়–ব্যয়ের হিসাবের মধ্যে কতটা ঘাটতি থাকে, সেটি কমিশনের কারিগরি কমিটি মূল্যায়ন করে দেখে। যদি মূল্যায়নে ধরা পড়ে ঘাটতি আছে, তবেই সেটি শুনানিতে আসে। এ বিবেচনায় ডিপিডিসি ও ডেসকোর দেওয়া মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বিইআরসি একটি নিরপেক্ষ কমিশন। এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ও গ্রাহকের মধ্যে একটি সমন্বয় করার চেষ্টা হয় সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ থেকে। যদি উৎপাদন ও বিতরণ টিকে না থাকে, তাহলে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হবে, সেটিও কমিশনের বিবেচনা থাকে।
অবশ্য আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, বিইআরসির আইনে পরিষ্কার করে বলা আছে, লাভে থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠান দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করতে পারে না। দাম বাড়ানোর প্রস্তাব হতে হবে যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত। গণশুনানিতে যাওয়ার আগে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব কমিশনের কাছে আমলযোগ্য হতে হবে। বিইআরসি নিজের আইন নিজে মানছে না, অথচ সেটির সুযোগ নেই।
দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া দুই কোম্পানি লাভে
ডেসকোর কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কর দেওয়ার পর ৫০ কোটি টাকা লাভ করেছে। আর এর আগের অর্থবছরে এ লাভের পরিমাণ ছিল সাড়ে ১৭ কোটি টাকা। সাম্প্রতিক সময় প্রতিষ্ঠানটি স্মার্ট প্রিপেইড মিটার সরাসরি কেনাকাটা (ডিপিএম বা ডাইরেক্ট পারচেজ মেথড) করার কারণে ব্যয় বেশি হয়েছে। সে কারণে লাভের পরিমাণ কম হয়েছে। তা না হলে আরও লাভ করত প্রতিষ্ঠান। ওই কর্মকর্তারা বলেন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১১২ কোটি টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৬৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছে ডেসকো। মুনাফা কমে গেলেও এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি লাভেই আছে।
ডেসকো পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানি। এ প্রতিষ্ঠানের ৭৫ শতাংশ শেয়ার সরকারের। বাকিটা সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকের কাছে রয়েছে। ২০১৫ থেকে টানা চার বছর, অর্থাৎ ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান নগদ ১০ শতাংশ প্রণোদনা দিয়েছে প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে।
অন্যদিকে, ডিপিডিসি পুঁজিবাজার নেই। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কর পরিশোধের পর ৭০ কোটি টাকা মুনাফা করে। আর তার আগের বছর প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা ছিল সাড়ে ৩২ কোটি টাকার বেশি।
ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান চাকমা বলেন, ‘পাইকারিতে দাম না বাড়ালে আমাদের বাড়াতে হবে না। যদি পাইকারিতে বাড়ে, তাহলে পাস থ্রো (সে পরিমাণ খুচরা পর্যায় বাড়ানো হবে) করার আবেদন নিয়ে এসেছি। এর সঙ্গে কিছু বিষয় যুক্ত করেছি, সেটি হলো ডিপিডিসি নতুন নতুন বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণ করছে, তার জন্য অর্থ দরকার। এ ছাড়া এসব কেন্দ্রে মানবসম্পদ নিয়োগ করতে হবে, তার জন্য অর্থ দরকার। এসব কারণে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে বিইআরসিতে এসেছি।’
ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহিদ সারোয়ারের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে কল করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।