ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে জ্বরে আক্রান্ত রোগী ক্রমেই বাড়ছে। রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকের চিত্র
ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে জ্বরে আক্রান্ত রোগী ক্রমেই বাড়ছে। রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকের চিত্র

ঠাকুরগাঁওয়ে বাড়ছে জ্বরের রোগী, করোনা পরীক্ষায় নেই আগ্রহ

ঠাকুরগাঁও শহরের একটি রোগনির্ণয় কেন্দ্রের চিকিৎসক হাবিব-ই-রসুলের চেম্বার। বাইরে অপেক্ষারত রোগী-স্বজনদের ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন জ্বরে ভোগা এক রোগী। কত দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন? চিকিৎসকের এ প্রশ্নে আমতা আমতা করছিলেন তিনি। চাপে পড়ে শেষমেশ জানালেন তিনি, পাঁচ দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। কথা শুনে চিকিৎসক তাঁকে করোনা পরীক্ষার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু কিছুতেই করোনা পরীক্ষা করতে রাজি নন তিনি। ওই রোগী উল্টো বলেন, ‘এটা ইনফ্লুয়েঞ্জা। ওষুধ দেন। ওষুধ খেলেই জ্বর সেরে যাবে।’

গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাতটার দিকের চিত্র এটি। চিকিৎসক হাবিব-ই-রসুল প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে করোনার উপসর্গ থাকলেও কিছুতেই মানতে চান না যে​ তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। এভাবেই জ্বরে আক্রান্ত রোগীরা করোনা পরীক্ষায় একেবারেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তিনি বলেন, বেশ কয়েক দিন ধরে দিনে তাপমাত্রা ওঠানামা করছে। দিনের বেলা প্রচণ্ড গরম ও ভোররাতে কিছুটা ঠান্ডা পড়ছে। আবহাওয়ার কারণেও জ্বর বেড়ে যেতে পারে। তবে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কাকেও কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৪২ জনের করোনা শনাক্ত

দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের আরটি-পিসিআর ল্যাব, ঠাকুরগাঁওয়ের বক্ষব্যাধি হাসপাতালের জিন এক্সপার্ট পরীক্ষা এবং সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পাওয়া অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী, সব মিলিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ১২৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৪২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৩৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত এক সপ্তাহে র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় ৫৪১টি নমুনা পরীক্ষা করে ২২৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ৪২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, গত বছরের ১১ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ে প্রথম করোনা সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হন। জেলায় এ পর্যন্ত ১০ হাজার ৭৬৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এসব নমুনা পরীক্ষা করে ২ হাজার ৬ জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গতকাল রাত পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে জেলায় মারা গেছেন ৫০ জন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১ হাজার ৬১২ জন সুস্থতার ছাড়পত্র পেয়েছেন।

আজ সোমবার বেলা ১১টার দিকে ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেখা যায়, রোগী গিজগিজ করছে। এ সময় হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক নাদিরুল আজিজ জানান, গত শনিবার ও গতকাল রোববার দুদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১ হাজার ১১২ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের ৪০ শতাংশের বেশি সর্দিজ্বরে আক্রান্ত।

জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে করোনার উপসর্গ থাকলেও কিছুতেই মানতে চান না যে​ তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। এভাবেই জ্বরে আক্রান্ত রোগীরা করোনা পরীক্ষায় একেবারেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় নিয়মিত রোগী দেখেন চিকিৎসক আতাউর রহমান। শনি ও রোববার দুদিনে তিনি শতাধিক রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। তিনি বলেন, এই দুই দিন তিনি যেসব রোগী দেখেছেন, তার ৯০ শতাংশই জ্বর, সর্দিকাশি, মাথাব্যথা নিয়ে এসেছিলেন। অনেক রোগীর ১০৩ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্বর ছিল।

রানীশংকৈল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ফিরোজ আলম বলেন, উপজেলায় সর্দিকাশি ও জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ব্যাপক বেড়েছে। এখন প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে গড়ে ১৬০ থেকে ১৮০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এসব রোগীর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই সর্দিকাশি ও জ্বরে আক্রান্ত।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আবুল কাশেম বলেন, আগে গ্রামের মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার কম ছিল। কিন্তু এখন শহর-গ্রাম সবখানে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। উপজেলা সদরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষই জ্বর নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বেশি আসছেন।

উপসর্গ নিয়েই অবাধে চলাফেরা

শহরের হাজিপাড়া এলাকার বাসিন্দা হ‌ুমায়ূন কবিরের (৫৩) পাঁচ দিন আগে প্রচণ্ড জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা ও শরীরব্যথা শুরু হয়। তবে চিকিৎসককে দেখাননি তিনি। শহরের একটি ওষুধের দোকান থেকে তিনি নিজেই অ্যান্টিবায়োটিক, প্যারাসিটামলসহ আরও কয়েকটি ওষুধ কিনে খেয়েছেন। এখন জ্বর সেরে গেলেও শরীরে দুর্বলতা ও মাথা ঘোরা রয়েই গেছে। করোনা পরীক্ষার ভয়ে তিনি চিকিৎসকের কাছে যাননি বলে জানালেন। জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি শহরের বাজারসহ বিভিন্ন লোকসমাগমস্থলে ঘুরে বেড়িয়েছেন বলেও স্বীকার করেছেন।

ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে জ্বরে আক্রান্ত রোগী ক্রমেই বাড়ছে। রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকের চিত্র

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার দুওসুও গ্রামের আল মামুন বলেন, কয়েক দিন ধরে তাঁর পরিবারের তিনজন জ্বর–কাশিতে ভুগছেন। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবনে কিছুটা উন্নতি হলেও তাঁরা পুরোপুরি সুস্থ হননি। এ অবস্থায় চিকিৎসক তাঁদের করোনা পরীক্ষার জন্য পরামর্শ দিলেও তাঁরা পরীক্ষা করাননি। মামুন বলেন, পরীক্ষার পর করোনা ধরা পড়লে বাড়ি লকডাউন করে দেবে। কোথাও প্রয়োজনে বেরও হওয়া যাবে না।

শহরের পৌর এলাকা ও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার দুওসুও, ভানোর, চাড়োল বড়পলাশবাড়ি এলাকার কয়েকটি ওষুধের দোকানে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দোকানে জ্বরের ওষুধ বিক্রি ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। শহরের শহীদ মোহাম্মদ আলী সড়কের ওষুধের দোকান জাওয়াদ ফার্মেসির মালিক মোহাম্মদ জুয়েল বলেন, জ্বরে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগী বা রোগীর স্বজন চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে দোকানে এসে উপসর্গের কথা বলে ওষুধ নিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। সামাজিক হেনস্তার শিকার হওয়ার ভয় থেকে জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগেরই করোনা পরীক্ষায় নেই আগ্রহ।

ঠাকুরগাঁও জেলায় ১৮ লাখ লোকের বসবাস। জেলা সদর ছাড়া বাকি চারটি উপজেলাই সীমান্তবর্তী। সেই তুলনায় এখন পর্যন্ত করোনা পরীক্ষা হয়েছে ১০ হাজার ৭৬৩টি। পরীক্ষার হার কম হওয়ায় করোনার প্রকৃত চিত্র বোঝা যাচ্ছে না।

ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের চিকিৎসক রাকিবুল আলম বলেন, চিকিৎসা দিতে গিয়ে রোগীদের কাছ থেকে তিনি জেনেছেন, গ্রামের ঘরে ঘরে মানুষের জ্বর হচ্ছে। তাঁদের অধিকাংশই এলাকার ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেয়ে সুস্থ হচ্ছেন। যাঁদের শ্বাসকষ্টসহ সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে, তাঁরাই কেবল চিকিৎসা নিতে আসছেন। তিনি জ্বরে ভোগা রোগীদের করোনা পরীক্ষার পাশাপাশি বাড়িতে আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দেন।

ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন মাহফুজার রহমান সরকার বলেন, ‘জেলায় জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। আবহাওয়ার কারণেও এটা হতে পরে। তবে এলাকায় করোনা সংক্রমণের বিষয়টিও আমরা অবজ্ঞা করতে পারছি না। সবার করোনা পরীক্ষার ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।’