খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার গাজীরহাট এলাকায় শনিবার মাছ ধরতে গিয়েছিলেন স্থানীয় এক জেলে। জালে ওঠে প্রায় ১০ কেজি ওজনের একটি কচ্ছপ। সুস্থ-সবল কচ্ছপটির পিটে বাঁধা যন্ত্র। বিষয়টি বুঝতে না পেরে কচ্ছপটি নিয়ে যান পুলিশ ক্যাম্পে। পরে জানা যায়, এটি স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার, আর কচ্ছপটি মহাবিপন্ন প্রজাতির। উদ্ধারের পর এটি রোববার সুন্দরবনের করমজল বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্রে আনা হয়েছে।
পরে পুলিশ বন বিভাগের কর্মকর্তাদের খবর দিলে তাঁরা এসে কচ্ছপটি উদ্ধার করেন। স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার দেখে বন বিভাগ নিশ্চিত হয়, কচ্ছপটি ভারত থেকে এসেছে। গবেষণার কাজে কচ্ছপের পিঠে ওই যন্ত্র যুক্ত করা হয়। স্যাটেলাইট তথ্য বলছে, উদ্ধার হওয়া কচ্ছপটি ছাড়াও একই সঙ্গে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে আরও একটি কচ্ছপ ছাড়া হয়। সেটিও বর্তমানে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জ এলাকার নদীতে বিচরণ করছে। প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ে কাজ করা সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে ‘বাটাগুর বাসকা’ প্রজাতির কচ্ছপ।
করমজল বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির প্রথম আলোকে বলেন, সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ প্রজাতির কচ্ছপ আছে। এর মধ্যে এই অঞ্চলে প্রায় ২৬টি প্রজাতির কচ্ছপ পাওয়া যেত। এর মধ্যে বাটাগুর বাসকার প্রজাতির কচ্ছপ আর দেখা যাচ্ছিল না। ফলে ২০০০ সাল থেকে গবেষকেরা ধারণা করেন, পৃথিবীতে আর বাটাগুর বাসকার কোনো অস্তিত্ব নেই। তা নিশ্চিতে ২০০৮ সালে গবেষকেরা প্রকৃতিতে বাটাগুর বাসকা আছে কি না, তা খুঁজতে শুরু করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নোয়াখালী ও বরিশালের বিভিন্ন জলাশয়ে আটটি বাটাগুর বাসকা পাওয়া যায়; যার মধ্যে চারটি পুরুষ ও চারটি নারী।
করমজল বন্য প্রাণী প্রজননকেন্দ্র থেকে জানা যায়, প্রজননের জন্য গাজীপুরে ভাওয়াল গড় নিয়ে যাওয়া হয় কচ্ছপগুলোকে। বন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেরা নিবিড়ভাবে লালন-পালন ও প্রজননের চেষ্টা করেন ওই কচ্ছপগুলোকে। সেখানে ভালো সাড়া না পাওয়ায় ২০১৪ সালে মূল আটটি বাটাগুর বাসকা, তাদের জন্ম দেওয়া ৯৪টি ছানাসহ করমজল প্রজননকেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। করমজলে বাটাগুর বাসকার গবেষণায় বন বিভাগের সঙ্গে আরও তিনটি সংস্থা যোগ দেয়। এগুলো হলো প্রকৃতি ও জীবন, ভিয়েনা চিড়িয়াখানার গবেষণা দল ভিয়েনা জু ও যুক্তরাষ্ট্রের কচ্ছপ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা টার্টেল সার্ভাইভাল অ্যালায়েন্স।
আজাদ কবির বলেন, ভারতেও মহাবিপন্ন প্রজাতির এই কচ্ছপগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছিল। বিলুপ্ত প্রজাতির কচ্ছপগুলোর জীবনাচার সম্পর্কে গবেষণার অংশ হিসেবে তারাও বিভিন্ন সময় ওই কচ্ছপগুলোর শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার যুক্ত করে সুন্দরবনের নদীতে অবমুক্ত করে। তারই একটি কচ্ছপ উদ্ধারের পর করমজলে আনা হয়েছে। কচ্ছপটি সুস্থ আছে। তবে এর পিঠের স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটারটি খুলে গেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
করমজল কেন্দ্রের বাটাগুর বাসকা প্রজেক্টের স্টেশন ম্যানেজার করমজল আবদুর রব বলেন, মহাবিপন্ন প্রজাতির এই কচ্ছপের গতিবিধি, বিচরণক্ষেত্র, খাদ্যাভ্যাস ও প্রজনন সম্পর্কে জানতে ভারতের টাইগার প্রজেক্ট গত ১৬ জানুয়ারিতে সে দেশের সজনেখালী এলাকার কুলতলীতে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো ১০টি কচ্ছপ অবমুক্ত করে। ধরা পড়া কচ্ছপটি নদী-সাগর হয়ে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার গাজীরহাটে চলে আসে। ভারতের এ ধরনের আরও একটি কচ্ছপ পূর্ব সুন্দরবনের বলেশ্বর ও ভোলা নদীতে বিচরণ করছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কচ্ছপের পিঠে বসানো স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটারের কার্যক্ষমতা এক বছর। এরপর এমনিতেই এটি খসে পড়ে যায়। এক বছরেই এর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।