পাখিটি হয়তো উড়তে উড়তে ঘুমায় অথবা ঘুমাতে ঘুমাতে উড়ে। প্রজননের প্রয়োজন ছাড়া অবতরণ করেই না। একে নিয়ে এমন গল্পও প্রচলিত আছে যে, মহাসাগরের ওপরে টানা চার-পাঁচ বছর ধরেও নাকি এরা ওড়ে। তবে পাখি বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ নিয়ে গবেষণার অবকাশ আছে।
যাই হোক, মহাসমুদ্রের এই পাখিটিকে বৃহস্পতিবার (২১ মে) সন্ধ্যার কিছু আগে রাজশাহীতে পদ্মা নদীর ওপরে উড়তে দেখা গেছে। পাখি গবেষকেরা বলছেন, এটি বাংলাদেশে একটি নতুন রেকর্ড। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই পাখিটিকে ক্যামেরাবন্দী করেছেন রাজশাহীর পাখিপ্রেমী মঈনুল আহসান শামীম। পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হকের মতে, বাংলায় পাখিটির নাম হতে পারে ‘কালচে পান চিল’ অথবা ‘সূতি পান চিল’। এর ইংরেজি নাম sooty tern।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান ছবি দেখে পাখিটির পরিচয় নিশ্চিত করেছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরের পরে আম্পানের প্রভাব কমে এলে রাজশাহী ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের চিকিৎসা কর্মকর্তা ও পাখিপ্রেমী মঈনুল আহসান, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি বাহিনীর রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক ও আলোকচিত্রী ফখরুল ইসলাম ও মুস্তাফিজুর রহমান রাজশাহীর পদ্মা নদীর মধ্যচরে ছবি তোলার জন্য বের হন। মধ্যচরে ঘণ্টাখানেক ছবি তোলার পর আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়। ফের বৃষ্টি শুরু হয়।
নৌকায় ওঠার পর মঈনুল আহসান নদীর মাঝখানে কালো রঙের চারটি পান চিল দেখতে পেলেন, কিন্তু ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করার আগেই পান চিলগুলো বেশ দুরে চলে যায়। ছবি তুলতে পারলেন না। মাঝিকে নৌকা ঘুরাতে বললে অপারগতা প্রকাশ করেন, মঈনুলের মনটা খারাপ হয় যায়। তারপর নৌকা ঘাটে ভিড়লে সবাই চলে যান। মঈনুল নৌকায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
কিছুক্ষণ পর আরও দুইটা কালো পান চিল আসে। ঝটপট ছবি তুলে নেন। মাত্র তিনটা ছবি ধরতে পারেন। সেটা সন্ধ্যার কিছু সময় আগের কথা। একে সন্ধ্যা, তার ওপর বৃষ্টির মধ্যে ক্যামেরার সেটিংস ঠিক ছিল কিনা দেখার সময় ছিল না। বাসায় এসে ক্যামেরা থেকে ছবি বের করে কিছুটা সম্পাদনা করে অধ্যাপক মনিরুল এইচ খানকে ইনবক্স করে ছবিগুলো পাঠান। অধ্যাপক মনিরুল নিশ্চিত করেন, এটা Sooty Tern এবং এটাও জানান, এটা বাংলাদেশে দেখা মেলার প্রথম রেকর্ড।
পরে মঈনুল আহসান মুঠোফোনে ফোন করে এই প্রতিবেদককে জানান, তিনি শুক্রবার দুপুর দুইটার দিকেও সূতি পান চিলের একটি দলকে দেখতে পেয়েছেন এবং ছবিও তুলতে সক্ষম হয়েছেন। দলটিতে ১০টির মতো পাখি ছিল।
বাংলাদেশে বার্ড ক্লাবের সাবেক সহসভাপতি অণু তারেক ২০১২ সালের ৮ মার্চ সচলায়তন ব্লগে লিখেছেন, ‘আবাসস্থল থেকে সমুদ্র যাত্রা করার পর এই পাখিরা টানা চার-পাঁচ বছর অবতরণ করে না। এদের পালক জলনিরোধক নয়। এরা সাঁতরাতে পারে না। কাজেই বলা যায়, এরা জলে ভেসে ভেসে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে না। তবে এই দীর্ঘ ভ্রমণে এরা কি ক্লান্ত হয়ে পড়ে না, স্ত্রী-পুরুষে কীভাবে মিলন ঘটে, ঝড়ের সময় কী পরিণতি হয়—এসব জানাতে আরও গবেষণার প্রয়োজন।’
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান প্রথম আলোকে বলেন, এটি গভীর সাগরের পাখি। রাজশাহীতে এই পাখিকে দেখা গেছে, এটা বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন রেকর্ড। বৃহস্পতিবার ঢাকায়ও একটি সাগরের পাখি দেখা গেছে। কলকাতায় কয়েকটি সাগরের পাখি দেখা গেছে। ঝড় থেকে বাঁচতে এই পাখি এদিকে চলে এসেছে। তিনি বলেন, মহাসাগরের অনেক পাখিই একটানা ওড়ে। এ জন্য কোনো কোনো পাখির পা নরম হয়ে যায়। তারা পায়ে ভর করে বসতে পারে না। বুক দিয়ে বসে। তবে টানা চার-পাঁচ বছর ওড়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত নয় বলে জানান তিনি।
যোগাযোগ করা হলে ইনাম আল হক বলেন, টার্ন শব্দের বাংলা অর্থ পান চিল। বাংলায় তারা ১৩ জাতের পান চিলের নাম দিয়েছেন। ইংরেজি sooty শব্দের অর্থ অনুযায়ী এই পান চিলের নামের আগে কালচে শব্দটা যোগ করে ‘কালচে পান চিল’ বলা যেতে পারে। আবার সূতি পান চিলও বলা যেতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এই পাখি এর আগে কেউ দেখেনি। ভবিষ্যতেও আর কেউ দেখবে কি না, বলা যায় না। কারণ ঝড় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে রাজশাহী ছেড়ে আবার মহাসমুদ্রের দিকে রওনা দিয়েছে।
এরা গভীর সমুদ্রের প্রবাল দ্বীপে প্রজনন করে। দীর্ঘ সময় উড়ার ব্যাপারে ইনাম আল হক বলেন, এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই যে, চার-পাঁচ বছর টানা এরা ওড়ে। তবে মহাসাগরের অনেক পাখিই দীর্ঘ দিন ওড়ে। এই জাতেরই একটি পাখি সূতি পান চিল। তবে এরা এত উড়ে যে, ঘুমাতে ঘুমাতে উড়ে অথবা উড়তে উড়তেই ঘুমাই। এদের স্বভাব এ রকম।