কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার উত্তরে (বাঁকখালী নদীর ওপারে) দেশের সর্ববৃহৎ ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার এ প্রকল্পে তৈরি হচ্ছে ১৩৭টি পাঁচতলা ভবন। প্রতিটি ভবনে ঠাঁই হবে ৩২টি করে জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারের। ইতিমধ্যে ২০টি ভবনে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে অন্তত ৬০০ পরিবারের আড়াই হাজার মানুষের। উদ্বাস্তুদের অধিকাংশই জেলে, শুঁটকিশ্রমিক, রিকশাচালক, ভ্যানচালক ও ভিক্ষুক। একসময় তাঁদের বসতি ছিল সমুদ্র উপকূলের নাজিরারটেক, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল এলাকার ঝুপড়িঘরে। এ প্রকল্পের কল্যাণে তাঁরা সবাই এখন ফ্ল্যাটের মালিক। গত বছরের জুলাইয়ে ফ্ল্যাট বাড়ির চাবি হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
জলবায়ু উদ্বাস্তুরা বলছেন, ঝুপড়িঘর থেকে তাঁরা ফ্ল্যাট বাড়িতে এসে নিরাপদে এবং সুখ–শান্তিতে থাকার সুযোগ পেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু প্রচণ্ড গরমে তাঁদের বড় সমস্যা পানি। পাইপলাইনের পানি লবণাক্ত, খাওয়ার অযোগ্য। বাধ্য হয়ে দুই–তিন কিলোমিটার দূর থেকে পানি সংগ্রহ করছেন তাঁরা। পানিসংকটের কারণে অনেকে সাত দিনেও গোসল করতে পারছেন না।
ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে নেমে সকাল, বিকেল, রাতে দূরের নলকূপ থেকে পানি আনতে হচ্ছে কিশোরী, তরুণী ও নারীদের। এতে তাঁদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ফ্ল্যাট বাড়ির সুখ-শান্তি ম্লান হচ্ছে নলকূপে।
১৬ মে দুপুর ১২টা! প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী ও গৃহবধূরা কলসি, প্লাস্টিকের বোতল নিয়ে ছুটছেন নলকূপের দিকে। এ প্রকল্পের উত্তর পাশে মসজিদ লাগোয়া একটি নলকূপ আছে।
কিশোরী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে নলকূপে পানি নিতে এসেছেন গৃহবধূ ছবিলা বেগম। তিনি থাকেন ‘বাঁকখালী’ ভবনের চতুর্থ তলায়। তিন বছর আগে তাঁর স্বামী মারা গেছেন। এক মেয়ে ও তিন ছেলে নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে ঝুপড়িঘর থেকে এখানে এসে উঠেছেন।
পানিসংকটের কথা তুলে ধরে ছবিলা বেগম (৪২) বলেন, ফ্ল্যাট বাড়িতে পাইপলাইনে যে পানি আসে তা লবণাক্ত, খাওয়ার অযোগ্য। আবার অধিকাংশ সময় লাইনে পানিও থাকে না। তাই নলকূপই ভরসা।
‘সাম্পান’ ভবনের তরুণী হামিদা বেগম বলেন, পানিসংকটের কারণে ঈদের দিনও তিনি গোসল করতে পারেননি। খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে দুই-তিন কিলোমিটার দূরের খুরুশকুল গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির নলকূপ থেকে। সন্ধ্যার পর দূরের গ্রামে গিয়ে মেয়েদের পানি আনাও নিরাপদ নয়। কারণ, প্রকল্প এলাকায় সীমানাপ্রাচীর নেই। সন্ধ্যার পর বখাটের উৎপাত লেগে থাকে।
খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অগ্রাধিকার প্রকল্প। বাঁকখালী নদীর তীরে এ প্রকল্পের আওতায় তৈরি হচ্ছে ১৩৭টি পাঁচতলা ভবন। যেখানে ঠাঁই হবে ৪ হাজার ৪০৯ পরিবারের অন্তত ২০ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের। গত বছরের ২৩ জুলাই গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রথম ধাপে তৈরি ২০টি ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় অন্তত ৬০০ জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারের হাতে ফ্ল্যাট বাড়ির চাবি হস্তান্তর করা হয়। চাবিতে লেখা ছিল ‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রামু ১০ পদাতিক ডিভিশন। পাঁচতলা প্রতিটি ভবনে ৬৫০ বর্গফুট আয়তনের ৩২টি করে ইউনিট (ফ্ল্যাট) আছে। ২০ লাখ টাকা দামের প্রতিটি ফ্ল্যাট বাড়ির মালিক হতে একেকটি পরিবারের খরচ হচ্ছে মাত্র ১ হাজার ১ টাকা।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের দেখভাল করছেন কক্সবাজার পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও সংরক্ষিত-১ আসনের কাউন্সিলর শাহিনা আকতার। পানিসংকটের কথা তুলে ধরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার শত শত নলকূপের পানি লবণাক্ত হয়ে গেছে। প্রচণ্ড গরমে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কিছু নলকূপের পানি শুকিয়েও গেছে। ফ্ল্যাট বাড়িতে পাইপলাইনে যে পানি সরবরাহ হচ্ছে, তা–ও লবণাক্ত এবং খাওয়ার অযোগ্য। এখন আড়াই হাজারের বেশি লোকজনের ভরসা একটিমাত্র নলকূপ। মানুষের চাপে বেশির ভাগ সময় বিকল থাকে নলকূপটি। তখন পানির জন্য ছুটতে হয় দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূরের গ্রামে।
শাহেনা আকতার বলেন, খাওয়ার পানিসংকট নিরসনে প্রকল্প এলাকায় অন্তত ১০টি নলকূপ স্থাপন জরুরি। কিন্তু পৌরসভায় এখন নলকূপ নেই। তারপরও অন্য উপায়ে নলকূপ স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি।
ফদনারডেইল উপকূলের ঝুপড়ি থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ‘শণখালী’ ভবনে ফ্ল্যাট বাড়িতে উঠেছেন নূর বানু। সঙ্গে দুই তরুণী মেয়ে। উপকূলে থাকতে ভিক্ষা করে সংসার চালাতেন নূর বানু। ফ্ল্যাট বাড়িতে এসেও ভিক্ষা করছেন।
কারণ জানতে চাইলে নূর বানু (৫৫) বলেন, ‘আয়রোজগার নাই, দুই মেয়ে নিয়ে বিপদে আছি। ভিক্ষা না করলে খাব কী?’
কুতুবদিয়াপাড়া উপকূল থেকে আসা শ্রমিক কামাল হোসেন (৫০) বললেন, ‘আগে উপকূলের শুঁটকিমহালে কাজ করে দৈনিক ৫০০ টাকা আয় হতো। করোনাকালে শুঁটকি উৎপাদন বন্ধ, আয় রোজগারের বিকল্প ব্যবস্থাও নেই। ধারদেনা ও স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে কোনোমতে রোজার মাসটা পার করেছি। ঈদ কাটছে অতি কষ্টে।’
একটি ফ্ল্যাট বাড়ির মালিক গৃহবধূ শিরিন আকতার বললেন, ‘এখন পাকা ভবনে ফ্যানের বাতাসে আরামে থাকতে পেরে আমরা খুশি। কিন্তু আয়রোজগারের বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে এ সুন্দর দিয়ে কী হবে?’
২০১৮ সালে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের করতে সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়। রানওয়েসহ অন্যান্য অবকাঠামো তৈরির জন্য অধিগ্রহণ করতে হয়েছে বিমানবন্দরের পশ্চিম পাশ লাগোয়া কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, নাজিরারটেক উপকূলের বিপুল পরিমাণ সরকারি খাসজমি। সেখানে এক যুগের বেশি সময় ধরে বসবাস করছিল চার হাজারের বেশি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ঘরবাড়ি হারিয়ে বিমানবন্দরের পাশে সমুদ্র উপকূলে আশ্রয় নিয়েছিলেন এসব গৃহহীন মানুষ। প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারে এসে জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, মাথা গোঁজার বিকল্প ঠাঁই না করে সরকারি খাসজমি থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা হবে না।
এরপর অধিগ্রহণ করা সরকারি খাসজমিতে বসবাসকারী ৪ হাজার ৪০৯ পরিবারের অন্তত ২০ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তুকে পুনর্বাসনের জন্য খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের জন্য খুরুশকুলে অধিগ্রহণ করা হয় ২৫৩ দশমিক ৩৫০ একর জমি। এ প্রকল্পে ১৩৭টি পাঁচতলা ভবন ছাড়াও ১০ তলার আরেকটি দৃষ্টিনন্দন ভবন হচ্ছে। ভবনটির নামকরণ হয়েছে ‘শেখ হাসিনা টাওয়ার’। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এ পর্যন্ত পাঁচতলাবিশিষ্ট ২০টি ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় আনা পরিবারগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকল্প এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল, ক্লিনিক, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, বিনোদনের পার্ক। উপকারভোগীদের অধিকাংশের পেশা ট্রলার নিয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ আহরণ এবং উপকূলে বিভিন্ন মহালে শুঁটকি উৎপাদন। শুঁটকি উৎপাদনের জন্য প্রকল্প এলাকায় তৈরি হবে আধুনিক শুঁটকিপল্লি।