বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস

জীববৈচিত্র্যের আধার সুন্দরবন

সুন্দরবনে এখন হরহামেশাই হরিণ দেখতে পান পর্যটকেরা। সম্প্রতি সুন্দরবনের কটকা এলাকায়
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

চারপাশে ছোট-বড় বিচিত্র ধরনের সবুজ গাছ। এর মাঝে ছোট ছোট খাল ও নদীর ধারা বয়ে চলেছে। গাছে পাখির কিচিরমিচির, বনে বাঘ-হরিণের দৌড়াদৌড়ি আর পানিতে মাছ-কুমিরের খেলা—এ নিয়েই গড়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের অংশ সুন্দরবন; জীববৈচিত্র্যের একটি বড় আধারও বটে।

জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্যের জন্য ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেসকো সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ায় সুন্দরবন এখন দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক ভ্রমণকেন্দ্র।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের রক্ষাকবজ হিসেবেও কাজ করে সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্টি হওয়া যেকোনো ঝড়-ঝঞ্ঝায় নিজের বুক পেতে দেয় এই বন। প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। ২০১৯ সালের জরিপে সুন্দরবনে প্রতি হেক্টরে কার্বন মজুদ আছে ১৩৯ মিলিয়ন টন। ২০০৯ সালে যার পরিমাণ ছিল ১০৯ মিলিয়ন টন। প্রতি বছর কার্বন মজুদের পরিমাণ বাড়ছে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পুরো সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার।

আয়তনের দিক দিয়ে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নিরবিচ্ছিন্ন জোয়ার-ভাটার ম্যানগ্রোভ বন হলো সুন্দরবন। এর বিস্তার বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অংশে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা পর্যন্ত। ব্রিটিশ-ভারত বিভক্তির পর সুন্দরবনের দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছে বাংলাদেশে, বাকিটা ভারতে। বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। এর ৬৯ শতাংশ স্থলভাগ ও ৩১ শতাংশ জল ভাগ।

সুন্দরবন

সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা ৫০টির বেশি প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের মধ্যে সুন্দরবনে টিকে আছে প্রায় ৩৫ প্রজাতির উদ্ভিদ। সুন্দরবনে বাঘ, হরিণ, শূকরসহ ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ প্রাণি বাস করে। এ ছাড়া আছে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণি। আর পাখি রয়েছে প্রায় ৩২০ প্রজাতির।

বন কর্মকর্তারা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে অনুপম অদ্বিতীয় সুন্দরবন গড়ে ওঠেছে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্য নিয়ে। বৈজ্ঞানিক, নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিবেচনায় সুন্দরবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীববৈচিত্র্যের আধার ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ১৯৯৭ সালে তিনটি অভয়ারণ্য এলাকাকে ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো। তিনটি বন্যপ্রাণির অভয়ারণ্য নিয়ে গঠিত ওই বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকার মোট আয়তন এক লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর।

সুন্দরবনের আশপাশে শিল্পকারখানা

সুন্দরবনের পাশেই মোংলা সমুদ্র বন্দর। এই বন্দরকে ঘিরে সুন্দরবনের আশপাশে ১৫৪টিরও বেশি বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠেছে। বিশেষ করে বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিবেশবাদীদের আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটিও।

সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেন, সুন্দরবনের আশপাশে যেভাবে শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে তাতে সুন্দরবনকে কোনোভাবেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সুন্দরবন একদিকে যেমন জীববৈচিত্র্যের আধার অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের রক্ষাকবজ। তাই এটা মানুষের স্বার্থের জন্যই রক্ষা করতে হবে। সুন্দরবন রক্ষার জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। এতে সুন্দরবন সুরক্ষা অনেক সহজ হবে, সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনা করা যাবে।

তবে খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো মনে করেন, সুন্দরবন প্রকৃতিগতভাবেই সৃষ্টি, প্রকৃতিই এর রক্ষক। এটা কখনো ধ্বংস হয়ে যাবে না। তারপরও সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

মিহির কুমার দো বলেন, বর্তমানে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ জায়গা অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কয়েকটি ডলফিন অভয়াশ্রমও গড়ে তোলা হয়েছে। বনের মধ্যে মিষ্টি পানি সংরক্ষণে ৪টি পুকুর নতুন করে খনন করা হয়েছে, পুনঃখনন করা হয়েছে ৮০টি পুকুর। টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করা হচ্ছে। শুরু হচ্ছে ইকোলজিক্যাল মনিটরিং কার্যক্রম। এ ছাড়া সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পও বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি ভালো রয়েছে সুন্দরবন।