তাঁতের খটাখট শব্দে মুখর গোটা গ্রাম। সামনে রেডিও বাজছে, তাঁতিরা একমনে শাড়ি বুনে চলেছেন। সূক্ষ্ম সুতার টানা আর ভরনায় হাতে নকশা তোলা হচ্ছে সুনিপুণ দক্ষতায়। প্রাচীন কৌশলের তাঁত অর্থাৎ পিট লুম বা গর্ত তাঁতে বোনা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম ধ্রুপদি বস্ত্র, জামদানি। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারগাঁও কাজীপাড়া গ্রামের চিত্র এটি। শুধু সোনারগাঁয়েই আছে দুই হাজার তাঁত। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ৮০০ পরিবার।
এদেরই পূর্বপুরুষ একসময় বুনেছেন বিশ্বের বিস্ময়বস্ত্র মসলিন। বয়নশিল্পীরা এখনো ধারণ করে চলেছেন সমৃদ্ধ বয়ন-ইতিহাসের পরম্পরা। বুনছেন মসলিনের উত্তরসূরি জামদানি। বয়নশিল্পীদের বয়নদক্ষতার স্বীকৃতি মিলেছে সম্প্রতি। বিশ্ব কারুশিল্প পরিষদ (ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফট কাউন্সিল বা ডব্লিউসিসি) গত ৮ অক্টোবর সোনারগাঁকে ‘বিশ্ব কারুশিল্প নগর’ (ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফট সিটি)–এর মর্যাদা দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম কোনো এলাকা এই অনন্য মর্যাদা পেল।
সরেজমিনে তাঁতের গ্রামে
বারগাঁও কাজীপাড়া গ্রামটি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলা থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে সাদিপুর ইউনিয়নে। গ্রামে একটিই বাজার। তার উত্তর দিকে শাহ আলমের বাড়ি। তিন পুরুষ ধরে এই তাঁত নিয়েই আছেন। সম্প্রতি বাড়িতে গিয়ে তাঁকে জামদানি শাড়ি বোনায় ব্যস্ত দেখা গেল। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, হাতের শাড়িটিতে সোনার প্রলেপের জরি ব্যবহার করেছেন। শাড়িটির কাজ প্রায় শেষের দিকে। বছরখানেক সময় লেগেছে এটি বুনতে। শাড়িটির দাম পড়বে আড়াই লাখ টাকা। কাজ শেষে এটি যাবে মুম্বাইয়ে এক অনলাইন ব্যবসায়ীর কাছে। ওই ব্যবসায়ী খ্যাতিমান এক অভিনেত্রীর জন্য শাড়িটির ডিজাইন পাঠিয়েছিলেন শাহ আলমের কাছে। ওই অভিনেত্রী শাড়িটি একবার পরার পর অনলাইন ব্যবসায়ী সেটি বিক্রি করবেন পাঁচ লাখ টাকায়। ভারত ছাড়াও ব্রিটেন, আফগানিস্তান, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে শাহ আলম তাঁর শাড়ি বিক্রি করেন। তবে খুবই কম দামে। অর্ডার দিলে বানিয়ে দেন।
শাহ আলমের বাড়ি থেকে মেঠোপথ ধরে মিনিট পাঁচেক এগোলে দর্গাবাড়ি গ্রাম। সে গ্রামে গিয়ে কথা হয় তাঁতি আবদুল জব্বারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তাঁর এখানেও ছয় মাস ধরে একটি শাড়ি বোনার কাজ চলছে। কলকাতার এক ব্যবসায়ী শাড়িটি অর্ডার দিয়েছেন। এটিরও দাম পড়বে আড়াই লাখ টাকা। যদিও ওই ব্যবসায়ী বেচবেন দ্বিগুণ দামে। তিনি বললেন, একটি জামদানি শাড়ি তৈরি করতে দুজন কারিগর প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কাজ করেন। সুতার মান ও কাজের সূক্ষ্মতা বিবেচনায় তাঁতিরা যে শ্রম দেন, সে অনুযায়ী দাম পান না।
শাহ আলম বললেন, তাঁদের গ্রামের নারী-পুরুষ-কিশোর-তরুণ প্রায় সবাই তাঁত চালান। তবে তাঁরা ভালো আছেন। আরও ভালো আছেন বিশ্ব কারুশিল্প শহরের মর্যাদা লাভের খবরে। নিজেদের কাজের স্বীকৃতি পেয়ে খুশি তাঁরা। এই মর্যাদা পাওয়ায় তাঁরা এখন বিশ্বের অনেক দেশেই জামদানি পাঠাতে পারবেন, পাবেন ন্যায্যমূল্য—এমনটাই আশা শাহ আলমের।
যেভাবে মিলল মর্যাদা
বিশ্ব কারুশিল্প নগরের মর্যাদা পাওয়া একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার অংশ। নির্দিষ্ট একটি জায়গাকে ‘বিশ্ব কারুশিল্প নগর’ বা ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফট সিটির মর্যাদা প্রদানের রেওয়াজ বেশি দিন আগের নয়। এর নেপথ্যে রয়েছে চীনের উদ্যোগ। ২০১২ সালে তারা ফুশিন শহরকে আলাদা মর্যাদা দেওয়ার দাবি তোলে ডব্লিউসিসির কাছে। ৮ হাজার বছরের পুরোনো শহরটি আকিক পাথরের জন্য বিখ্যাত। প্রক্রিয়া স্থির করে শহরটিকে ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফট সিটির মর্যাদা দিতে এক বছর সময় লেগে যায়। সে বছরই ফুশিন পায় ‘চায়না অ্যাগেট সিটি’ হিসেবে ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফট সিটির মর্যাদা।
এরপর থেকে বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদও সোনারগাঁর জন্য একই মর্যাদা নিশ্চিত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছিল, জানালেন কারুশিল্প পরিষদের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফটস কাউন্সিলের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট রুবি গজনবী।
২০১৬ সালে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) পণ্যের মর্যাদা পায় জামদানি। ওই বছরই জামদানিকে বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে আনুষ্ঠানিক আবেদন করা হয়। এর পরের দুই বছর লেগেছে বিভিন্ন পূর্বশর্ত পূরণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। সর্বশেষ গত বছর বিশ্ব কারুশিল্প পরিষদ বিচারকমণ্ডলী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আর বাংলাদেশে জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের উদ্যোগে জামদানি উৎসবের আয়োজন করা হয়। এরই অংশ হিসেবে বেঙ্গল শিল্পালয়ে হয় বড় প্রদর্শনী। জুরিরা যাতে ওই সময় সোনারগাঁ পরিদর্শন করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করা হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও সংস্থাও সহযোগিতা করে।
জামদানি উৎসব শুরু হয় গত ৬ সেপ্টেম্বর। তার আগে ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন বিশ্ব কারুশিল্প পরিষদের তিন বিচারক ঘাধা হিজাউই-কাদুমী, উষা কৃষ্ণান ও সুরাপি রোজানাভংসে। বিচারকেরা সরেজমিনে সোনারগাঁ যান এবং জামদানি বয়নের নানা পর্ব পর্যবেক্ষণ করেন।
উৎসবের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘর থেকে পঞ্চাশ থেকে আড়াই শ বছরের পুরোনো ৫০০ জামদানির ছবি সংগ্রহ করা হয়। এসব ছবি থেকে বাছাই করে আড়ং, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির, অরণ্য ও কুমুদিনীর সহায়তায় ৮০টি শাড়ি বোনা হয়। অনিন্দ্যসুন্দর শাড়িগুলোর একটি অংশ করেন সোনারগাঁর বয়নশিল্পীরা। টানা ও ভরনায় ২০০ কাউন্ট খাদি সুতায় বোনেন শাড়িগুলো।
বিচারকেরা ঢাকায় অবস্থানকালেই সোনারগাঁর বিশ্ব কারুশিল্প শহরের মর্যাদাপ্রাপ্তির ব্যাপারে ইতিবাচক আভাস দেন। এরপর চলতি বছরের ৮ অক্টোবর মেলে বহুল কাঙ্ক্ষিত সেই স্বীকৃতি।
বিশিষ্টজনদের কথা
‘জামদানি বাংলাদেশের’ এই স্বীকৃতিতে সেটা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সোনারগাঁর ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্পের সুনামকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করল বলে মনে করেন জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই গৌবর কেবল সোনারগাঁর নয়, গোটা বাংলাদেশের। পরিষদের পক্ষ থেকে অচিরেই প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতিপত্র হস্তান্তর করা হবে জানিয়েছেন পরিষদের সভাপতি।
সোনারগাঁর সদ্যবদলি হওয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অঞ্জন কুমার সরকার জানান, সোনারগাঁ ‘ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফট সিটি’র স্বীকৃতি জামদানি বয়নশিল্পীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তা করবে। বয়নশিল্পীরা তাঁদের পণ্য বিনিময় এবং রপ্তানি করতে পারবেন। এই মর্যাদার ফলে জামদানি শিল্পের পীঠস্থান হিসেবে সোনারগাঁর সুনাম ও কৃতিত্ব বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত হলো।
জামদানি উৎসবের পৃষ্ঠপোষক ছিল বেঙ্গল প্রুপ। বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ও নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক জসিমউদ্দিন এই মর্যাদা পেতে তাঁদের সহযোগিতা করেছেন। তিনি বলেন, এখন প্রয়োজন একটি তাঁতপল্লি। এ ছাড়া সোনারগাঁ উপজেলাকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারকে প্রস্তাব দেবেন তাঁরা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের তাঁতিদের কাজ গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।