প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো নৌযান ডাকাতের কবলে পড়ছে। আগে প্রতি লঞ্চে তিনজন করে নৌ পুলিশ দেওয়া হলেও এখন দেওয়া হচ্ছে না।
কুশিয়ারা নদীতে যাত্রীবাহী এমভি শিবপুর লঞ্চে গত রোববার রাতে হওয়া ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করতেই কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোরশেদ জামানের সাফ কথা, দুর্ঘটনাস্থলের জলসীমা তাঁর থানার অধীন নয়। এই জলসীমা হয় হবিগঞ্জের লাখাই থানার, না হয় হতে পারে ভৈরব নৌ পুলিশের।
অষ্টগ্রাম থানার ওসির দাবির বিষয়ে লাখাই থানার ওসি সাইদুল ইসলাম চমকে ওঠেন। কোনোভাবেই ডাকাতির দায় নিতে রাজি নন তিনি। পরে তিনি বলেন, ডাকাতির স্থলটির ধারেকাছেও তাঁর থানার জলসীমা নেই।
ভৈরব নৌ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. সাইদুর রহমানের দাবি একই। তাঁর ভাষ্য, যে স্থানে ডাকাতি হয়েছে, ওই স্থানের জলসীমা তাঁর ফাঁড়ির নয়, মিঠামইন নৌ ফাঁড়ির। তবে ভৈরব ফাঁড়ির এমন দাবি উড়িয়ে দেন মিঠামইন নৌ ফাঁড়ির ইনচার্জ আনোয়ার হোসেন।
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরই মধ্যে লঞ্চ ডাকাতির দুই দিন পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে ডাকাত দলের কেউ গ্রেপ্তার হননি। এমনকি লাগোয়া চার থানা–পুলিশের কেউ ডাকাতির দায় নিতে রাজি নন। মূলত জলসীমা জটিলতার কারণে এখন পর্যন্ত লঞ্চ ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়নি। এতে অপরাধীরা আছেন অনেকটা নিরাপদে।
এমভি শিবপুর লঞ্চের তত্ত্বাবধায়ক জয়নাল মিয়া। হাওরের নৌপথে তিনি ৪৫ বছর ধরে লঞ্চ পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেন, ডাকাতি হলেই আশপাশের থানার পুলিশ জলসীমা বিরোধে জড়িয়ে পড়বেন—এ আর নতুন কী? পুরোনো অভ্যাস। শুধু এ কারণে নৌ ডাকাতির ৮০ ভাগ ঘটনার মামলা হয় না। ফলে নদীপথের প্রকৃত চিত্র কোনো দিন উঠে আসে না।
তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনার তিন ঘণ্টা পর অষ্টগ্রাম থানার পুলিশ এসে ডাকাতের কবলে পড়া যাত্রীদের উদ্ধার করেন। সবকিছু লিখে নিয়ে যান। তারপরও মামলা না হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ থাকতে পারে না।
ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানান, এমভি শিবপুর লঞ্চটি যাতায়াত করে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের মার্কলী লঞ্চঘাট থেকে ভৈরব পর্যন্ত। প্রায় ৭০ জন যাত্রী নিয়ে রোববার রাত ৮টার দিকে লঞ্চটি মার্কলী থেকে ভৈরবের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ভোর তিনটার দিকে লঞ্চটি কুশিয়ারা নদীর অষ্টগ্রামের কলমা ইউনিয়নের ইকুরদিয়া পয়েন্ট অতিক্রম করছিল।
সেই সময় ডাকাতেরা ট্রলারযোগে এসে লঞ্চের গতি রোধ করেন। শুরুতে কয়েকজন যাত্রীকে এলোপাতাড়ি মারধর করে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেন। এতে কয়েকজন যাত্রী আহত হন। পরে যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ টাকা, ৩০টি মুঠোফোন সেট ও স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যান। ভুক্তভোগীরা জরুরি সেবা ৯৯৯–এ কল দিয়ে সহযোগিতা চান। কয়েক ঘণ্টা পর অষ্টগ্রাম থানার পুলিশ আসে। দুর্ঘটনার সাড়ে তিন ঘণ্টা পর লঞ্চটি ফের ভৈরবের উদ্দেশে ছেড়ে আসে।
লঞ্চরে সারেং মাঈন উদ্দিন। ডাকাত দলের হামলায় তিনিও আহত হন। তিনি বলেন, ‘মামলার বিষয়ে অষ্টগ্রাম থানায় যোগাযোগ করলে তাঁরা ভৈরব নৌ পুলিশের কথা বলেন। ভৈরব নৌ পুলিশ অন্য থানা দেখিয়ে দেয়। এখন আমরা কোন থানায় যাব।’
লঞ্চ ও ট্রলার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা জানান, ভৈরবের সঙ্গে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের বাণিজ্য নদীকেন্দ্রিক। কিন্তু প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো নৌযান ডাকাতের কবলে পড়ছে। আগে প্রতি লঞ্চে তিনজন করে নৌ পুলিশ দেওয়া হলেও এখন দেওয়া হচ্ছে না। হাওরের নৌযানে ডাকাতি করতে কয়েকটি ডাকাত দল সক্রিয় আছে। ডাকাতির সময় ডাকাতেরা কৌশলী হন।
বিশেষ করে তাঁরা ডাকাতির স্থান হিসেবে বেশির ভাগ সময় তিন জেলার মোহনা বেছে নেন। এটি করা গেলে পরে জলসীমা নিয়ে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ বিরোধে জড়ায় এবং শেষে আর মামলা হয় না। এতে ডাকাতেরা আইনি জটিলতা এড়াতে পারেন। মূলত পুলিশের জলসীমার বিরোধে হাওরের নৌপথ পুরোপুরি নিরাপদ করা যাচ্ছে না।
কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা ও নরসিংদী জেলা নিয়ে নৌ পুলিশ কিশোরগঞ্জ অঞ্চল। কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) মোফাজ্জল হোসেন। গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মাসুম বলেন, জলসীমা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয় সত্য, তবে এ কারণে মামলা না হওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বিষয়টি দেখছেন।